Advertisement
১১ মে ২০২৪

স্কোয়াডে যোগ দাও, বাড়ি বয়ে হুমকি মাওবাদীদের

শুধু অন্ধকারে ব্যানার-পোস্টার ফেলে চলে যাওয়া আর তোলা চেয়ে হুমকি-চিঠি দেওয়ার মধ্যে আর জঙ্গলমহলে মাওবাদী কার্যকলাপ আটকে থাকল না। গৃহস্থের ঘরে ঢুকে হুমকি দেওয়াও আবার শুরু করল সশস্ত্র মাওবাদীরা। বৃহস্পতিবার রাতে পুরুলিয়ার বলরামপুরের তিলাগোড়া গ্রামের ঘটনা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২৭
Share: Save:

শুধু অন্ধকারে ব্যানার-পোস্টার ফেলে চলে যাওয়া আর তোলা চেয়ে হুমকি-চিঠি দেওয়ার মধ্যে আর জঙ্গলমহলে মাওবাদী কার্যকলাপ আটকে থাকল না। গৃহস্থের ঘরে ঢুকে হুমকি দেওয়াও আবার শুরু করল সশস্ত্র মাওবাদীরা।

বৃহস্পতিবার রাতে পুরুলিয়ার বলরামপুরের তিলাগোড়া গ্রামের ঘটনা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই গ্রামের বাসিন্দা এক তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁর যুবক ছেলেকে স্কোয়াডে যেতে জোর করে দুই মহিলা-সহ ছ’জন মাওবাদীর একটি স্কোয়াড। যার মধ্যে অন্তত তিন জনের কাঁধে আগ্নেয়াস্ত্র ও পরনে জলপাই রঙের পোশাক ছিল বলে ওই যুবক দাবি করেছেন। তাঁর বক্তব্য, দু’-তিন জনের মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। তৃণমূলকর্মী ও তাঁর ছেলে অবশ্য কৌশলে পালিয়ে যান। আতঙ্কিত পিতা-পুত্র রাতটা কাটান অন্য গ্রামে। তিন বছর পর জঙ্গলমহলে এই ধরনের ঘটনা ঘটল বলে গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের দাবি।

বৃহস্পতিবারই তিলাগোড়া গ্রামের বাসিন্দা, মধ্যবয়স্ক এক কাঠুরিয়াকে মাওবাদীদের চর সন্দেহে তৃণমূলের কিছু কর্মী-সমর্থক কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে মারধর করে বলে অভিযোগ উঠেছে। তিলাগোড়া গ্রামটি অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে। ওই তল্লাট থেকেই ২০১০-এর অক্টোবরে রাজ্য গোয়েন্দা শাখার (আইবি) ইন্সপেক্টর পার্থ বিশ্বাস ও তাঁর বন্ধু, পেশায় স্কুলশিক্ষক সৌম্যজিৎ বসুকে অপরহণ করে খুন করেছিল মাওবাদীরা।

জঙ্গলমহলে সাম্প্রতিক মাওবাদী সংক্রান্ত পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতে শুক্রবার মেদিনীপুরে রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন। ২১ সেপ্টেম্বর ছিল সিপিআই (মাওবাদী)-এর দশ বছর পূর্তি। ওই তারিখের আশপাশে জঙ্গলমহলে মাওবাদী আনাগোনা বাড়তে পারে বলে গোয়েন্দারা আগেই সতর্ক করেছিলেন। সেই আশঙ্কারই প্রমাণ মিলেছিল গত সপ্তাহে পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি ও পুরুলিয়ার আড়শা ও বলরামপুরে মাওবাদীদের নাম লেখা ব্যানার-পোস্টার উদ্ধারের ঘটনায়। তা ছাড়া ‘মাওবাদী রাজ্য সম্পাদক’ আকাশের নামে তোলা চেয়ে হুমকি চিঠি পেয়েছেন লালগড়ের কয়েক জন বাসিন্দা। তার আগে, গত সপ্তাহেই বেলপাহাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে, ঝাড়খণ্ডের চেকামের জঙ্গলে মাওবাদীদের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে প্রাণ হারান বীরভূমের বাসিন্দা এক কোবরা জওয়ান।

এই প্রেক্ষাপটে এ দিন মেদিনীপুর পুলিশ লাইনের ‘সেফ হাউস’-এ হওয়া বৈঠকে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলা এবং ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলাকে চূড়ান্ত সতর্ক করা হয়েছে। ওই বৈঠকে উপস্থিত রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তার বক্তব্য, “জঙ্গলমহল ঘেঁষা ঝাড়খণ্ডের গ্রাম ও জঙ্গলগুলিতে গত কয়েক দিন মাওবাদীদের আনাগোনা হঠাৎই বেড়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে ওরা কিছু করার ছক কষেছে।” ওই আধিকারিকের কথায়, “মাওবাদীরা যাতে ঝাড়খণ্ড থেকে ঢুকে পড়ে আঘাত হানতে না পারে, সেটা সুনিশ্চিত করতে যাবতীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে এ দিনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে।” ওই বৈঠকে মাওবাদী প্রভাবিত বলে চিহ্নিত জেলাগুলির পুলিশ সুপারেরা ছাড়াও রাজ্য পুলিশের কয়েক জন শীর্ষকর্তা এবং সিআরপি-র আইজি বিবেক সহায় উপস্থিত ছিলেন।

বৃহস্পতিবার রাতে পুরুলিয়ার তিলাগোড়া গ্রামের তৃণমূলকর্মী নিতাই পাহাড়িয়ার বাড়িতে ঝাড়খণ্ড থেকে মাওবাদীরা ঢুকেছিল বলে তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করছেন। পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি ও বলরামপুরের তৃণমূল নেতা সৃষ্টিধর মাহাতোর কথায়, “এলাকায় এখন মাওবাদী বলে কিছু না থাকলেও বাইরে থেকে এসে ওরা এই ধরনের হুমকি দিতে পারে।” পেশায় কৃষিজীবী নিতাইবাবুর ছেলে, বছর কুড়ির দীপক জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় তাঁদের বাড়িতে মাওবাদীরা ঢোকে। কড়া নাড়ার শব্দে দীপক দরজা খুলতেই দেখেন, ছ’জন দাঁড়িয়ে। তারা জানায়, দীপককে স্কোয়াডে যেতে হবে। কিন্তু ওই যুবক আপত্তি জানিয়ে বলেন, ওই পথে গেলে কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তার পর মাওবাদীরা নিতাইবাবুর খোঁজ করেন।

কিন্তু বাড়ির ভিতর থেকে ওই কথোপকথন শুনে পিছনের দরজা দিয়ে আগেই চম্পট দেন ওই ব্যক্তি। তার পর দীপকও ‘বাবাকে ডেকে আনছি’ বলে ওই পথেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পিতা-পুত্র দু’জনে অন্য গ্রামে কাটানোর পর সকালে তৃণমূলের স্থানীয় পার্টি অফিসে যান। মাওবাদীরা অবশ্য ওই বাড়ির অন্য সদস্যদের কোনও ক্ষতি করেনি। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমার বলেন, “খোঁজ নিয়ে দেখছি, ঠিক কী ঘটেছে।” একই বক্তব্য বলরামপুরের বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোর। বস্তুত, একটা সময়ে বলরামপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় মাওবাদীরা মুক্তাঞ্চল তৈরি করেছিল। তিন বছর ধরে পরিস্থিতি শান্ত। সৃষ্টিধর মাহাতোর বক্তব্য, “শান্তি নষ্ট হতে দেব না। এর মোকাবিলা করা হবে।”

আসলে জঙ্গলমহলের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কা করছে তৃণমূল। শাসকদল যে স্বস্তিতে নেই এবং স্থানীয় নেতাদের একাংশ যে ‘মাওবাদী ভূত’ দেখছেন, সেটা বৃহস্পতিবারের একটি ঘটনাতেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে বলে এলাকার মানুষের অনেকেরই অভিযোগ। মাওবাদীদের চর সন্দেহে বৃহস্পতিবার তৃণমূলের কয়েক জন কর্মী-সমর্থকের হাতে যে ব্যক্তি প্রহৃত হয়েছেন, সেই আষাঢ়ি পাহাড়িয়া জঙ্গলের কাঠ বেচতে উরমা হাটে যাচ্ছিলেন। তখনই তাঁর পথ আটকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। আষাঢ়ির স্ত্রী হেমলতা দেবী এ দিন বলেন, “হাটে কাঠ বিক্রি করেই আমাদের দিন গুজরান হয়। এখন মার খেয়ে আমার স্বামী শয্যাশায়ী। কী ভাবে সংসার চালাব, জানি না।”

বৃহস্পতিবারই তৃণমূল প্রভাবিত ‘জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি’ বলরামপুরে দলীয় পতাকা নিয়ে বিশাল মোটরবাইক মিছিল বের করে। আষাঢ়ির অভিযোগ, মিছিলে থাকা কয়েক জনই তাঁকে রাস্তা থেকে তুলে পার্টি অফিসে নিয়ে গিয়ে মারধর করে। পুলিশ এবং তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের অবশ্য দাবি, এ রকম ঘটনার কথা তাঁদের জানা নেই। মাওবাদীদের ঠেকাতে পুরুলিয়ার বান্দোয়ানেও ‘সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি’ গড়া হয়েছে শাসকদলের উদ্যোগে। তবে ওই কমিটিতে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেসের স্থানীয় কর্মী-সমর্থকেরাও সামিল হয়েছেন।

মাওবাদীদের নামে হুমকি চিঠি, গ্রেফতার যুবক

মাওবাদীদের নাম করে হুমকি চিঠি দিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টার অভিযোগে এক যুবককে গ্রেফতার করল পুলিশ। ধৃত কমল মাহাতোর বাড়ি ঝাড়গ্রাম থানার গড় শালবনির চণ্ডীপুরে। বৃহস্পতিবার ধৃতকে ঝাড়গ্রাম এসিজেএম আদালতে হাজির করা হলে পাঁচ দিন পুলিশ হাজতের নির্দেশ হয়েছে। শুক্রবার মেদিনীপুরে সাংবাদিক বৈঠকে ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার ভারপ্রাপ্ত সুপার ভারতী ঘোষ বলেন, “ধৃত যুবক মাওবাদী নয়। তবে মাওবাদীদের নাম করে কয়েক জন ব্যবসায়ীকে হুমকি চিঠি পাঠিয়েছে। জেরায় ওই যুবক তা স্বীকারও করেছে।” পুলিশ সুপার জানান, পশ্চিম মেদিনীপুরের কিছু এলাকা থেকে একই ধরনের অভিযোগ আসছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Maoism Maoist purulia jungle mahal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE