সঞ্জয় বারু, নটবর সিংহের পরে এ বার কমিউনিস্টরা। বই-বিতর্কের মরসুমে নতুন সংযোজন!
লোকসভা ভোটে বেনজির বিপর্যয়ের আবহে দলের সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ সে ভাবে পালন করছে না সিপিএম। কিন্তু দল প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্থপতি হিসাবে সিপিএমে মুজফ্ফর আহমেদের (কাকাবাবু) সিংহাসন অটুট। তিনিই একমাত্র নেতা, যাঁর জন্মদিন পালন করে সিপিএম। আজ, মঙ্গলবার ফের সেই বাৎসরিক অনুষ্ঠান। আর তার আগেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের নতুন বই প্রকাশ করে কাকাবাবুকে নিয়ে বিতর্ক সামনে এনে ফেলল সিপিআই! পুরনো কমিউনিস্ট নেতাদের সম্পর্কে কাকাবাবুর মনোভাব এবং এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে তাঁর নিজের ভূমিকা নিয়েই গুরুতর প্রশ্ন তোলা হয়েছে সিপিআইয়ের বইয়ে।
আদি কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে সিপিআই ধারাবাহিক ভাবে ‘বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস অনুসন্ধানে’র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিছু দিন ধরে। আগেই প্রকাশিত হয়েছে ওই সিরিজের ১২টি খণ্ড। এ বার ত্রয়োদশ খণ্ডে যাবতীয় দলিল-নথিপত্র-সহ তুলে ধরা হয়েছে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসের ঘটনাবলি। পঞ্চাশ বছর আগে যে সময়ে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করে বেরিয়ে এসেছিলেন কাকাবাবু-সহ ৩২ জন। ওই বছরে তাঁরাই সিপিএম নামক নতুন দলের প্রতিষ্ঠাতা। পার্টি বিভাজনের বছরের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইতিহাস সিরিজের ত্রয়োদশ খণ্ডে সিপিআই দেখিয়েছে, ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদি পর্বের সৈনিকদের সম্পর্কে কাকাবাবুর মূল্যায়ন কতটা ‘সঙ্কীর্ণ’ ছিল। তবে কাকাবাবুর প্রতি পাল্টা এই আক্রমণ সিপিআই নিজেদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে করেনি। গৌতম চট্টোপাধ্যায়-সহ কয়েক জন কমিউনিস্ট ইতিহাসবিদ যাবতীয় নথিপত্র ঘেঁটে এবং তখনকার ঘটনার সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে যে তথ্য পেয়েছিলেন, তাকেই ফের তুলে ধরা হয়েছে এ বারের বইয়ে।
কাকাবাবুর লেখা ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ বইটি এ দেশের কমিউনিস্ট মহলে যথেষ্ট সমাদৃত। বিশেষত, সিপিএম নেতা-কর্মীদের কাছে। কিন্তু সিপিআইয়ের দাবি, ভারতের আদি কমিউনিস্টদের সম্পর্কে যে সব মন্তব্য কাকাবাবু তাঁর বইয়ে করেছিলেন, তা আদৌ বাস্তবসম্মত নয়। গৌতমবাবুর যে লেখা সিপিআইয়ের বই পুনর্মুদ্রিত করেছে, সেখানে পরিষ্কারই বলা হয়েছে: ‘ইতিহাসের এ রকম সরল চিত্র আমরা কোথাও দেখিনি যে, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদি যুগে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেই ছিলেন ‘বদমাইশ’, ‘সুবিধাবাদী’ বা ‘এজেন্ট’।” সেখানে দেখানো হয়েছে, মানবেন্দ্রনাথ রায়, নলিনী গুপ্ত, অবনী মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, এস এ ডাঙ্গে, সওকত উসমানি, গোপেন চক্রবর্তী, ধরণী গোস্বামী বা সি চেট্টিয়ারদের যে ভাবে ‘হেয়’ করেছিলেন কাকাবাবু, তথ্য ঘেঁটে সেই মূল্যায়নের সমর্থন মেলেনি। শুধু তা-ই নয়। সে যুগে কাকাবাবুই একমাত্র ‘সাচ্চা কমিউনিস্ট’ ছিলেন, এমন ধারণাকেও নস্যাৎ করতে চাওয়া হয়েছে এ বারের খণ্ডে। দেখানো হয়েছে, ব্রিটিশ ‘সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’ থেকে বিরত থাকলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হবে না, এমন সওয়ালই করেছিলেন কাকাবাবু। অর্থাৎ তাঁর যুক্তি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসের পক্ষে! গৌতমবাবুদের প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘তাঁর (কাকাবাবু) এই সর্বনাশা রাজনীতি জয়যুক্ত হলে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে আদি যুগেই অন্তের ইতিহাস লিখতে হতো’! পার্টি বিভাজনের পরে ১৯৭০ সালে প্রথম বার প্রকাশিত এই সব তথ্য সিপিআইয়ের নতুন করে সামনে আনার মধ্যেই বিতর্কের ইন্ধন দেখতে পাচ্ছে বাম মহল।
সিপিআইয়ের ওই ইতিহাস সিরিজের অন্যতম সম্পাদক ভানুদেব দত্ত বলছেন, “সেই সময়ের ঘটনা সম্পর্কে কে কী বলছেন, আমাদের এবং বিভাজনপন্থীদের অবস্থান কী ছিল, এ সবই আমরা পাশাপাশি বইয়ে রেখেছি। যাতে মানুষ কোনটাকে ঠিক বলবেন, সেটা তাঁরাই পড়ে যাচাই করে নিতে পারেন।” এত সবের পরেও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ফের এক হওয়ার পক্ষেও অবশ্য জোরালো সওয়াল করছেন ভানুদেববাবুরা। আর সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের মত, “কার সম্পর্কে তিনি কী লিখেছিলেন, সেটাই কাকাবাবুর একমাত্র মূল্যায়ন নয়। এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস নিজ গুণেই তাঁকে মনে রাখবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy