দমদমে সিন্ডিকেট বচসার জেরে যে দিন মৃত্যু হল এক তরুণ তৃণমূল সমর্থকের, সে দিনই দুর্গাপুরে দলের শ্রমিক সংগঠনের এক বৈঠকে এই নিয়ে দলের ভিতরকার বিভাজনের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। শোভনদেববাবু জানিয়েছেন, দলের পুরনো কর্মীরা এ সবের সঙ্গে যুক্ত নন। তাৎপর্যপূর্ণ হল, নতুন তৃণমূলীদের দিকে আঙুল তুলে তিনি যে অভিযোগ করেছেন, সেই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে দুর্গাপুর থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে দমদমের মধুগড়েও। সোমনাথ সাধুখাঁর দেহ সেখানে পৌঁছনোর পরে উত্তেজিত জনতার একটি অংশকে বলতে শোনা গিয়েছে, পুরনোদের ভুলে এখন নতুন লোক আনছে, এই দল আর টিকবে না!
সিন্ডিকেট জালে এ ভাবেই ক্রমে জড়িয়ে পড়ছে তৃণমূল। দলীয় নেতৃত্ব অস্বস্তি কাটানোর চেষ্টা করলেও নেতাদের পরস্পর-বিরোধী কথায় সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে। এ দিনও যেমন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় সিন্ডিকেট নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেন, “সিন্ডিকেটের সঙ্গে তৃণমূল জড়িত নয়। এ সব মিথ্যা প্রচার।” অথচ একই দিনে দুর্গাপুরে রাজ্য সরকারি সংস্থা ‘দুর্গাপুর প্রজেক্টস লিমিটেড’ (ডিপিএল) এর আইএনটিটিইউসি কর্মীদের একাংশের সঙ্গে বৈঠক শেষে তৃণমূল বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “দলের কোনও পুরনো কর্মী এ সব নিয়ে মারামারি করছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। দল ক্ষমতায় আসার পরে নতুন অনেকে এসেছে। তারাই এ সব করছে। কোনও পুরনো কর্মী এ সব করে দলের ক্ষতি করতে পারে না।”
শোভনদেবের কথায় দু’টি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত, মুকুলবাবু যতই প্রকাশ্যে বলুন ‘এর সঙ্গে তৃণমূলের কেউ জড়িত নন’, দলের অন্য নেতারা সকলেই সেটা মানছেন না। এর আগে নিউ টাউনে সিন্ডিকেট নিয়ে দলের গোষ্ঠী সংঘর্ষের পরে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “কোনও ঘটনাই আমাদের দৃষ্টির বাইরে নেই। এটা দলের ব্যাপার। আমাদের দেখতে দিন।” তার পরেও মুকুলবাবু জানিয়েছিলেন, দলের কেউ যুক্ত নন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি যে ভিন্ন, তা বোঝা যায় নিউ টাউনে যুযুধান দুই পক্ষকে নিয়ে যখন বৈঠক করেন মুকুলবাবু। সেই বৈঠকে তিনি নেত্রীর বার্তা শুনিয়ে সকলকে সাবধান করে দেন। তবু পরিস্থিতি যে বদলায়নি, দমদমের গোলমাল তার উদাহরণ।
দ্বিতীয়ত, পুরনোদের আলাদা করে দিয়ে শোভনদেব দেখাতে চাইলেন, গণ্ডগোলের মূলে নব্য তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। যে কথা শোনা গিয়েছে নিউ টাউন বা দমদমে সাধারণ মানুষের মুখেও। দমদমে তো শনিবার প্রশ্ন উঠেছে, সিন্ডিকেট ব্যবসায় কেন রাজনৈতিক মদত নেওয়া হচ্ছে? (দমদমের খবর পৃঃ ৬)। এই সূত্রে তৃণমূল নেতাদের একটি অংশ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ক্ষমতায় আসার পরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সতর্ক করে দেন, সিন্ডিকেট ব্যবসার সঙ্গে তৃণমূলের কেউ যেন যুক্ত না থাকেন। তার পর থেকে মুকুলবাবু তো বটেই, ফিরহাদ হাকিম-সহ তৃণমূল নেতাদের অনেকেই জোর গলায় বলেছেন, সিন্ডিকেটের সঙ্গে দলের কেউ যুক্ত নয়। কিন্তু ঘটনা হল, নেত্রীর নির্দেশের উল্টো পথে হেঁটে তৃণমূল নেতারা এখন বিষয়টিকে নিজেদের আকচাআকচির জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। এবং যে যা-ই বলুন না কেন, বাস্তব কারও অজানা নয়।
শোভনদেববাবুর বক্তব্যে দলের অন্দরে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, দলীয় নেতৃত্ব যখন সিন্ডিকেটের সমস্যাকে মেটাতে চাইছেন, তখন শোভনদেববাবুর এ সব কথায় নতুন করে জটিলতা বাড়বে। দলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, “শোভনদেববাবু দলের অভ্যন্তরে গোলমাল জিইয়ে রাখতে অহেতুক প্ররোচনা দিচ্ছেন।” ওই নেতার অভিযোগ, দলের শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ পদ থেকে তাঁকে সরানোর পর থেকেই শোভনদেব নানা বিষয়ে নেতৃত্বের বিরোধিতা করছেন। কিন্তু শোভনদেবাবুর ঘনিষ্ঠ নেতাদের অনেকেরই বক্তব্য, “এটা ভুলে গেলে চলবে না, উনি দলের প্রথম বিধায়ক। দলের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না।” তাঁদের আরও অভিযোগ, দল ক্ষমতায় আসার পরে সিপিএম এবং বিভিন্ন বাম দল থেকে যাঁরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, তাঁদেরই একটা অংশ সিন্ডিকেট ব্যবসায় জড়িত। শোভনদেববাবু ওই ‘নবাগত’দের সম্পর্কেই সতর্ক করতে চেয়েছেন বলে তাঁর অনুগামীদের বক্তব্য।
যে কারণেই তিনি এ কথা বলুন না কেন, শোভনদেব কিন্তু সিন্ডিকেট আঁচ আরও একটু উস্কেই দিলেন।