Advertisement
E-Paper

৭ বছর আগে জঙ্গি-আঁতুড়ে হাত দিয়েও হাত গোটায় পুলিশ

ভাঙাচোরা পিচ-রাস্তা ছেড়ে ঢালু পথ নেমে গিয়েছে পশ্চিম মুখে। অল্প এগোলে বাঁশঝাড়ে ঘেরা নতুন দোতলা বাড়ি। গায়ের প্লাস্টারে এখনও রঙের পোঁচ পড়েনি। এখানেই তা হলে ছিল জঙ্গি মডিউলের গর্ভগৃহ! এনআইএ-সূত্রের খবর, ক’বছর আগে নতুন বাড়িটির জায়গায় যে পরিত্যক্ত, জরাজীর্ণ দালানবাড়ি চোখে পড়ত, সেটাই পশ্চিমবঙ্গে উগ্রপন্থার অন্যতম সূতিকাগারের ভূমিকা পালন করে এসেছে।

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০৪

ভাঙাচোরা পিচ-রাস্তা ছেড়ে ঢালু পথ নেমে গিয়েছে পশ্চিম মুখে। অল্প এগোলে বাঁশঝাড়ে ঘেরা নতুন দোতলা বাড়ি। গায়ের প্লাস্টারে এখনও রঙের পোঁচ পড়েনি।

এখানেই তা হলে ছিল জঙ্গি মডিউলের গর্ভগৃহ!

এনআইএ-সূত্রের খবর, ক’বছর আগে নতুন বাড়িটির জায়গায় যে পরিত্যক্ত, জরাজীর্ণ দালানবাড়ি চোখে পড়ত, সেটাই পশ্চিমবঙ্গে উগ্রপন্থার অন্যতম সূতিকাগারের ভূমিকা পালন করে এসেছে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ যে জঙ্গি-গোষ্ঠীর হদিস দিয়েছে, সাত বছর আগে ওই ভগ্নপ্রায় বাড়ির মধ্যেই মিলেছিল তার শিকড়ের ইঙ্গিত। পুলিশ তখন ঠিকঠাক তদন্ত করলে চক্রান্তের জাল হয়তো ছড়ানোর আগেই ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া যেত বলে জাতীয় তদন্তকারীরা আফশোস করছেন। ওঁদের একাংশের অভিযোগ, কাগজে-কলমে ঘটনাটির গুরুত্ব খাটো করে দেখিয়ে রাজ্য পুলিশ কার্যত ষড়যন্ত্রকে ধামাচাপা দিয়েছে। যা কিনা আখেরে পশ্চিমবঙ্গে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর মদতে পুষ্ট জঙ্গিপনার বাড়বাড়ন্তের পথ প্রশস্ত করেছে। এই পরিণতির দায় রাজ্যের তদানীন্তন সরকারও এড়াতে পারে না বলে মনে করছে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ।

মুর্শিদাবাদের বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া লালগোলা। গঞ্জের পাঁচ কিলোমিটার দূরে ফতেপুর। ময়া পঞ্চায়েত-এলাকার গ্রামটিরই পরিত্যক্ত বাড়িতে ২০০৭-এর ৯ এপ্রিল বিকেলে অতর্কিতে হানা দিয়ে তিন জনকে পাকড়াও করে পুলিশ, জেহাদি মতাদর্শ ও দেশ-বিরোধী ভাবধারা প্রচারের অভিযোগে। জেলা পুলিশের খবর, ধৃতদের কাছে মিলেছিল সন্দেহজনক বিস্তর জিনিসপত্র ওসামা বিন লাদেনের বক্তৃতা থেকে আরম্ভ করে আফগানিস্তানের তোরা বোরার পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণের সিডি, প্রচার-পুস্তিকা ইত্যাদি।

সেই তদন্তের সূত্রে ধরা পড়েন এক খারিজি মাদ্রাসার প্রধান মৌলানা। পুলিশের কাছে খবর ছিল, ফতেপুরের প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে রামনগর গ্রামের ফাঁকা মাঠে গড়ে ওঠা মাদ্রাসাটিতে বাইরের লোকজন এসে দেশ-বিরোধী প্রচার চালাচ্ছে। মৌলানার ঘরের আলমারিতেও জেহাদি বইপত্র পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত, খাগড়াগড়-সূত্রে জঙ্গি মডিউলের অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে যে মকিমনগর মাদ্রাসার নাম উঠে এসেছে, রামনগর থেকে তার দূরত্ব সাকুল্যে ছ’কিলোমিটার। এবং এনআইএ জেনেছে, ফতেপুর ও রামনগর দুই ডেরায় পাওয়া হাতে লেখা বেশ কিছু চিরকুটের হরেক জায়গায় লেখা ছিল একটি বিশেষ শব্দ জেএম।

এনআইএ-র এক অফিসারের দাবি, খাগড়াগড়-কাণ্ডে ধৃত সাজিদ, হাকিমদের মুখে জানা গিয়েছে, ‘জেএম’ আসলে জামাতুল মুজাহিদিন। বাংলাদেশে জেএমবি, এখানে শুধু জেএম। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল হাকিম জেরায় স্বীকার করেছে, সে জেএমের সদস্য। “ফতেপুর-রামনগরের পুলিশি তদন্ত ঠিকঠাক এগোলে তখন জেএমের অর্থ বোঝা কঠিন হতো না। জেএমবি-র সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটাও সামনে এসে পড়ত।” আক্ষেপ করেছেন এনআইএ-র এক তদন্তকারী। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “এ রাজ্যের পুলিশ অফিসারদের কেউ কেউ খাগড়াগড় বিস্ফোরণও ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। কিন্তু সাত বছর আগের ঘটনাটা দিব্যি চাপা পড়েছিল।”

আর তা দেখেই বাংলাদেশের জেএমবি-চাঁইরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে বলে এনআইএ মনে করছে। এক অফিসারের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গকে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ জেলাকে তারা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ধরে নেয়। একের পর এক জেএমবি নেতা ভারতে ঢুকে ঘাঁটি গাড়ে। যেমন খাগড়াগড় বিস্ফোরণে নিহত শাকিল আহমেদ। কিংবা হাতকাটা নাসিরুল্লা, সাজিদের আগে যে ছিল ভারতে জেএমবি-র মাথা।” এমনকী, সাজিদও ২০০৭-এ ভারতে যাতায়াত শুরু করেছিল বলে এনআইএ-র সন্দেহ।

এমতাবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গি ‘নেটওয়ার্ক’-এর উৎস সন্ধানে নেমে এনআইএ লালগোলার ওই সাত বছরের পুরনো মামলা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছে। লালবাগ মহকুমা আদালতে বিচারাধীন মামলাটির কাগজপত্র দেখতে গিয়ে রীতিমতো তাজ্জব বনে গিয়েছেন এনআইএ-র তদন্তকারীরা। কেন?

কারণ, পুলিশ যে তাতে দেশদ্রোহের ধারাই দেয়নি!

এনআইএ-সূত্রের খবর: লালগোলা থানায় মামলাটি (কেস নম্বর ৮১, তারিখ: ৯/৪/২০০৭) রুজু করা হয়েছিল শুধু অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র (১২০-বি ধারা) ও অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শত্রুতা ছড়িয়ে শান্তিভঙ্গের চেষ্টার (১৫৩-এ ধারা) অভিযোগে। উল্লেখ্য, খাগড়াগড়-কাণ্ডেও রাজ্য পুলিশ প্রথমে দেশদ্রোহের অভিযোগ না-এনে নিছক অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ধারায় মামলা করেছিল। পরে চাপের মুখে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের (ইউএপিএ) মতো কঠোর ধারা যোগ করা হয়।

সাত বছর আগে লালগোলায় সে সব হয়নি। গ্রেফতারির দু’মাস সাত দিনের মাথায় লালগোলা থানার পুলিশ চার অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করে। ধৃত চার জনই জামিন পেয়ে যান। ওই তদন্তে যুক্ত ছিলেন, মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশের এমন এক অফিসারের অবশ্য দাবি, দেশদ্রোহের ধারা প্রয়োগ করার মতো প্রমাণ তাঁদের হাতে মজুত ছিল। “প্রমাণ পেয়েছিলাম যে, রামনগর-ফতেপুরে অস্ত্র প্রশিক্ষণের উপযোগিতা ব্যাখ্যা বা সঙ্কেত উদ্ধারের পাঠ চলছিল। কিছু কাগজপত্র যে বাংলাদেশ থেকে এসেছে, তা-ও বুঝতে পেরেছিলাম।” বলছেন তিনি। তা হলে ধারা প্রয়োগ হল না কেন?

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের দিকে তিনি আঙুল তুলছেন। বলছেন, “হঠাৎই শুনতে পেলাম, উপরমহলের নির্দেশ আছে যে, দেশদ্রোহের মামলা করা যাবে না।” উপরমহল মানে? ওঁর ব্যাখ্যা, “বলা হয়েছিল, মহাকরণের নির্দেশ এসেছে।” লালগোলা-তদন্তে যুক্ত থাকা জেলা পুলিশের আর এক অফিসারের মন্তব্য, “ঊর্ধ্বতন অফিসারদের নির্দেশেই দেশদ্রোহের মামলা রুজু করা হয়নি।” তখন মুর্শিদাবাদের এসপি ছিলেন যিনি, সেই রাহুল শ্রীবাস্তব বর্তমানে দিল্লিতে ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েটের ডেপুটি সেক্রেটারি। যোগাযোগ করা হলে এ প্রসঙ্গে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।

লালগোলার ঘটনাটির সময়ে রাজ্যে ছিল বামফ্রন্ট সরকার, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০০২-এর জানুয়ারিতে কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের সামনে জঙ্গি হানার অব্যবহিত পরে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেববাবুই মন্তব্য করেছিলেন, কয়েকটি মাদ্রাসা জঙ্গি কার্যকলাপের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। ক’দিনের মধ্যে অবশ্য বুদ্ধবাবু দাবি করেন, এমনটি তিনি বলতে চাননি। সিপিএম-সূত্রের খবর, পার্টির একাংশের চাপেই বুদ্ধবাবু নিজের কথা গিলতে বাধ্য হন। এখন খাগড়াগড়-কাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সিপিএম-ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দাগছে। কিন্তু লালগোলায় অত গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত যে ভাবে হাল্কা করা হল, তার দায় বাম সরকারের উপরে বর্তায় না কি?

সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা রায়গঞ্জের সাংসদ মহম্মদ সেলিমের জবাব, “এনআইএ যদি মনে করে থাকে তদন্ত যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তে নিয়ে যাওয়া হয়নি, তবে তারা কারণ খুঁজে বার করুক।” পাশাপাশি ওঁর সংযোজন, “খাগড়াগড়কে আজমগড় (ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনখ্যাত উত্তরপ্রদেশের জেলা) বানানোর চেষ্টা হচ্ছে না তো? এনআইএ-কে দিয়ে যাতে অনর্থক ভীতি সঞ্চারের চেষ্টা না হয়, সেটাও দেখা জরুরি।”

মুর্শিদাবাদ পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, লালগোলা-কাণ্ডে গ্রেফতারির প্রতিবাদে সে সময়ে স্থানীয় কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ দেখান। বিক্ষোভের অন্যতম সংগঠক ছিলেন মহম্মদ শাহাবুদ্দিন, এখন যিনি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া (এসডিপিআই)-র নেতা। শাহাবুদ্দিনের বক্তব্য, “আমরা মূলত রামনগরের খারিজি মাদ্রাসার প্রধান মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মুক্তির দাবিতে সরব হয়েছিলাম। আমরা মনে করি, উনি নির্দোষ। বাকি তিন জনের কথা বলতে পারব না।”

ফতেপুরের পরিত্যক্ত বাড়িতে দুই যুবকের সঙ্গে ধরা পড়েছিল নুর ইসলাম ওরফে নুর। জেহাদ-শিক্ষার্থীদের কাছে সে নিজের পরিচয় দিত শেখ বিলাল হিসেবে, বলত তার বাড়ি বাংলাদেশের রাজশাহিতে। পরে অবশ্য পুলিশ জানতে পারে, নুর আদতে মুর্শিদাবাদের নবগ্রামের মোমিনাবাদ গ্রামের বহু পুরনো বাসিন্দা। এনআইএ সম্প্রতি সেখানে গিয়ে নুরের সঙ্গে কথা বলেছে। গ্রামে তার ওষুধের দোকান রয়েছে। কিন্তু সাত বছর আগে সে বাংলাদেশি সেজেছিল কেন?

জেলা পুলিশের এক অফিসারের ব্যাখ্যা, “হতে পারে, তখন রাজশাহি থেকে কোনও বিলালের এখানে ঢোকার কথা ছিল। আসল বিলালকে আড়াল করে ও চাইছিল পুরো ব্যাপারটা ঘেঁটে দিতে।”

বস্তুত এমন বহু ধাঁধার উত্তর পুলিশের অজানা থেকে গিয়েছে। “আমাদের তো এগোতেই দেওয়া হয়নি!” খেদ করেছেন ওই অফিসার। এনআইএ জেনেছে, নুরেরা গ্রেফতার হওয়ার কয়েক দিন বাদে লালগোলার স্টেশন মাস্টার জেএমের নামে একটা হুমকি-চিঠি পেয়েছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, বিস্ফোরণে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন উড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রায় একই সময়ে পুলিশ খবর পায়, মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে গঙ্গাপাড়ের এক খারিজি মাদ্রাসায় পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকেছে বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু এ সব নিয়েও পুলিশ বিশেষ এগোতে পারেনি অজ্ঞাত কোনও কারণে।

খাগড়াগড়ের উৎস খুঁজতে এখন লালগোলার পুরনো ধাঁধা সমাধানের চেষ্টা করছে এনআইএ।

surbek biswas lalgola khagragarh blast terror hideout nia
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy