‘‘হুই কত্তা। সইন্ধ্যা লাগনের আগে কিসু ক্যাঁকড়া নামিয়ে দিয়ে যাও গো। বাইরে থেকে সায়েবরা আসছেন।’’
সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে ঝুপঝাপ বৈঠা মারতে মারতে দ্রুত পাশ কাটিয়ে এগোলো নৌকো। বোধহয় অনেক কাজ বাকি রয়ে গিয়েছে তাদের।
এখনও সন্ধ্যা নামতে দেরি। পশ্চিমগামী সূর্য নির্মেঘ বৈশাখের আকাশে দিনভর খেলেছে। আর যার জেরে চারপাশের থইথই জলাভূমিতে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে সোনা-রুপো! সন্ধ্যা নামতে দেরি থাকলেও, একটা অজানা গন্ধ চারদিকের অয়েলপেন্টিং-এর মতো এই অরণ্যে যেন স্প্রে করে দিয়েছে কেউ। সেই সোঁদা গন্ধ আতঙ্কের।
যশোহর বিমানবন্দর থেকে চার ঘণ্টার রাস্তা উজিয়ে মংলা বন্দর হয়ে সুপতী নদীতে আপাতত ভেসে রয়েছি। সামনেই মোহনা, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সুন্দরবনের নদীর মিলনক্ষেত্র। এসেছি সোঁদরবনের রাজার দেশে। বাংলাদেশ সরকারের নিমন্ত্রণ এবং আতিথ্যে জলপথে দু’রাত কাটানো এখানে নতুন তৈরি হওয়া পর্যটন-পোত ‘সেলার’-এ।
গত রাতে অর্ধেক কাদা আর অর্ধেক বালিময় এক বিপদসঙ্কুল রাস্তা দিয়ে হেঁটে বদর বদর বলতে বলতে স্পিড বোটে চড়ে যখন জাহাজটিতে এসে উঠেছিলাম, চারদিক তখন আলকাতরার মতো ঘন কালো। তারই মধ্যে যেন আরও একটু বেশি কালো হয়ে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে, জলের পাশের ঠাসা ঝোপ। আমাদের এই সুন্দরবন ভ্রমণের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন রিয়াজভাই। বাংলাদেশ পর্যটন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত। সঙ্গে বিদেশমন্ত্রকের সদাহাস্যমুখ অফিসার নির্ঝর অধিকারী এবং নাসিরুদ্দিন। রিয়াজভাই রাতেই ঘোষণা করেছিলেন, ভোর ৬টার মধ্যে আবার জাহাজ থেকে নেমে বোটে চড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। কোনও এক খাঁড়ির কাছে গিয়ে ভিড়বে বোট। তার পর জঙ্গলে নেমে হাঁটা।
মোট বারো জন আমন্ত্রিত সাংবাদিকের সদস্য দলের মধ্যে ৭০ শতাংশই সাহেব। আমার মতো বঙ্গসন্তানের কথা বাদ থাক। রিয়াজের এই জঙ্গলভ্রমণের ঘোষণায় তাঁদের লাল টুকটুকে মুখও দেখি পলকের জন্য ফ্যাকাশে মেরে গেল! আর বোধহয় সেটা নজর করেই রিয়াজের পরবর্তী স্বস্তিবচন, ‘‘ভয় নেই। সরকার আমাদের দু’জন রাইফেলধারী সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে।’’ ওই রাইফেলের গুলিতে বাঘের গায়ে মাছি বসলে মারা চলবে কি না, সেই নিয়ে আড্ডায় কাটল রাতভর। কাছেই বঙ্গোপসাগর। তার নুন মেশানো ঝাপট দেওয়া হাওয়ায়, জাহাজের ডেকে উথালপাথাল। বাংলাদেশের আকাশ মাথার উপরে নিয়ে।
বাকিটা পড়তে ২ ক্লিক করুন
ভোরের সুন্দরবনের রিংটোন অচেনা অজানা পাখির ডাকে সেট করা! চড়ায় হেঁটে বেড়াচ্ছে সাইবেরিয়া থেকে এসে আর ফেরৎ না যাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির বক। জলের কাছে ঝুঁকে আসা জঙ্গলের কাছে ধার ঘেঁষে চলছে আমাদের বোট। একটি খাঁড়ি থেকে অন্য খাঁড়ি হয়ে। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের কাছে কটকায় নামার সময় এল সাবধানবাণী, ভুল করে পাথর ভেবে যেখানে সেখানে পা ফেলবেন না। একটু দেখে নিতে হবে। অনেক সময় এই বৈশাখেও কুমিরেরা রোদ পোয়াতে আসে কিনা!
একেই বোধহয় বলে ভয়ঙ্কর সুন্দর। এক দিকে গোলপাতা, গেঁহু, গরান, কলাগাছের ঝোপ উজাড় করে দিয়েছে তার সৌন্দর্য। এঁটেল মাটির মানচিত্রে শ্বাসমূলের বিচিত্র গ্রাফিতি। হঠাৎ ঝোপ সরিয়ে দেখা টলটলে ছোট্ট দিঘিতে লাল শালুক ফুলের অপূর্ব রূপকথা। অন্য দিকে সর্বদাই একটা গা ছমছমে ভাব। জংলা পাতার আড়াল থেকে কোনও অদৃশ্য চোখ যেন সদাসর্বদা নজর রাখছে আপনাকে। মেপে যাচ্ছে আপনার পদক্ষেপ।
‘‘সর্বদা দল বেঁধে হাঁটুন। ছবি তোলার নেশায় আলাদা হয়ে যাবেন না’’— বার বার বলছেন দুই পুলিশকর্মী, রিয়াজ এবং বাংলাদেশ সরকারের দুই অফিসার। দল বেঁধে এগোলে নাকি সাধারণত বাঘ ঘেঁষে না। আর শুধু বাঘ তো নয়, এখানে রয়েছে ভয়ঙ্কর হিংস্র বন্যবরাহও। হাঁটার পথে, কাছে দূরে একাধিক বার দেখা গিয়েছে যাদের মন দিয়ে কাঁকড়ার বাসা খুঁড়তে।
এক জন আগে, এক জন পিছনে বন্দুকধারী। তাঁদের এক জন সাজ্জাদ হুসেন প্রায় বারো বছর রয়েছেন বাংলাদেশের পুলিশ দফতরে, সুন্দরবনে কর্মরত। বারো বছরে বার দশেক সামনে থেকে দেখেছেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বহু বার শনাক্ত করে ফিরিয়ে এনেছেন অর্ধভুক্ত লাশ। ‘‘লাশ টেনে ন্যে আসার সময় সে তাদের কি রাগ। চক্ষুদু’টা বনবন করে ঘুরতে থাকে যেন!’’ অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন সাজ্জাদ। তখন রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ করে দল বেঁধে টিন পিটিয়ে দূরে সরাতে হয় দক্ষিণ রায়কে!
সুন্দরবনের বাঘ স্বরাট, স্বয়ম্ভূ। একটি বিরাট এলাকা জুড়ে থাকে একটি বাঘ। আর সেই এলাকার মধ্যে থাকে একাধিক ‘টাইগার ডেন’। সেটা আর কিছুই নয় একটু উঁচু বালির ঢিপির মতো। যেখানে শিকার ধরে টেনে আনে বাঘ। তার পর সেখানে পচায় শিকারকে। বোঁটকা গন্ধ বেরোলে তখন খায় সেখানে বসে।
সবুজ জঙ্গলের মধ্যে এ যেন এক বালিরঙা ডাইনিং টেবিল বসানো রয়েছে! সেখানকার গরান গাছগুলির গায়ে আঁচড়ের দাগ স্পষ্ট। রিয়াজভাই জানালেন ওটা বাঘের আঁচড়। নিজের এলাকার সীমা চিহ্নিত করার জন্য। নিজের এলাকায় অন্য কোনও প্রাণী, এমনকী, অন্য বাঘকেও ঘেঁষতে দেয় না সেখানকার অধিবাসী ব্যাঘ্রটি।
তবে সুন্দরবন মানে কি শুধুই বাঘ অথবা বাঘের আতঙ্ক? এটা ঠিকই যে পশ্চিমবঙ্গের দিককার সুন্দরবনের মতো এখানে গ্রাম প্রায় নেই বললেই হয়। রয়েছে ঘন জঙ্গল এবং ধু ধু বালির চড়া। যেখানে এই নিদাঘ বেলায় অভিশাপের মতো জেগে রয়েছে পত্রহীন বৃক্ষ। বাতিল হয়ে যাওয়া নৌকাডুবির স্মৃতি বুকে নিয়ে ভাঙাচোরা নৌকো। সাগরের জল এসে জোয়ারের সময় যার কাঠকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। যেখানে জল খেতে আসে দলবদ্ধ হরিণেরা। যেখানে পোষা উদবেড়ালকে নৌকা থেকে বকলস পরিয়ে জলে নামিয়ে দেওয়া হয় মাছ তাড়িয়ে জালের কাছে নিয়ে আসার জন্য। কিছু মাছ তারা নিজেরাও উদরস্থ করে। মধুসন্ধানীরা সব ভয় জয় করে চলে যায় অরণ্য গভীরে, চাক ভাঙার সরঞ্জাম নিয়ে। বাঘ কাছে চলে এলে সাবধান করে দিতে ডালে ডালে হুটোপাটি করতে থাকে বাঁদরেরা, ‘কল’ দিতে থাকে অবিরাম।
আতঙ্ক এবং আতঙ্ককে জয় করার মন্ত্র— একইসঙ্গে বুকে নিয়ে রাত-দিন জেগে থাকে ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটারের এই বিপুল জীবজগৎ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy