Advertisement
০২ এপ্রিল ২০২৩

যুদ্ধের হুঙ্কারও থামাতে পারেনি আহমেদের নাচ

ছোটবেলা থেকেই নাচ-অন্ত প্রাণ আহমেদের। বাবার আপত্তি সত্ত্বেও তালিম নিয়েছিলেন ব্যালেতে। ১৬ বছর বয়সে যোগ দেন সিরিয়ার বিখ্যাত ব্যালে গোষ্ঠী ‘এনানা ডান্স থিয়েটার’-এ। নাচের অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন কাতার, টিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, লেবানন ও জর্ডনে।

শিল্পী: আইফেল টাওয়ারের সামনে আহমেদের নাচ। —ফাইল চিত্র।

শিল্পী: আইফেল টাওয়ারের সামনে আহমেদের নাচ। —ফাইল চিত্র।

সীমন্তিনী গুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৮ ০৪:০৬
Share: Save:

নাচো, না হলে মরো।

Advertisement

গর্দানের এই উল্কির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আহমেদ জুদের গল্প। তাঁর জীবনের। তাঁর লড়াইয়ের। তাঁর শিল্পের।

সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস। সেখানকার প্যালেস্তাইনি অধ্যুষিত শহরতলি এলাকা ইয়ারমুক ক্যাম্পে জন্ম আহমেদের। মা সিরীয়, বাবা প্যালেস্তাইনি।

ছোটবেলা থেকেই নাচ-অন্ত প্রাণ আহমেদের। বাবার আপত্তি সত্ত্বেও তালিম নিয়েছিলেন ব্যালেতে। ১৬ বছর বয়সে যোগ দেন সিরিয়ার বিখ্যাত ব্যালে গোষ্ঠী ‘এনানা ডান্স থিয়েটার’-এ। নাচের অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন কাতার, টিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, লেবানন ও জর্ডনে।

Advertisement

‘‘গৃহযুদ্ধ পুরো ছবিটাকে পাল্টে দিল,’’ ই-মেলে জানালেন আহমেদ। ‘‘তখন আমি বছর কুড়ি। প্রথমে সিরীয় সেনার সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষ। তার পরে আইএসের হামলা। বোমা আর গুলি আমাদের পুরো এলাকাটাকে শেষ করে দিল। যে যেখানে পারল, পালাল। আমার বাবাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমি আর আমার মা রয়ে গেলাম ইয়ারমুকে।’’

নাচ বা অন্য যে কোনও শিল্পের উপর ফতোয়া জারি করেছে মৌলবাদী জঙ্গিরা। আহমেদের কথায়, ‘‘কোনও পুরুষ নৃত্যশিল্পী ওদের কাছে অত্যন্ত ঘৃণার বস্তু। আমার বোমায় উড়ে যাওয়া ভাঙা ছাদে যখন নাচতাম, মনে হত যে কোনও দিক থেকে জঙ্গির গুলি ছুটে আসবে। তবু থামিনি, এক মুহূর্তের জন্যও!’’ শুধু নাচ চালিয়ে যাওয়াই নয়, বিনা পয়সায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নাচ শেখাতেও শুরু করেন তিনি। আর এই সময়ে প্রতিবাদী উল্কি আঁকেন ঘাড়ে— ‘নৃত্য ইয়া মরো!’ হ্যাঁ, দেবনাগরীতে।

আরও পড়ুন: দারুণ গরম চোখ রাঙাচ্ছে ইউরোপে

হঠাৎ ভারতীয় ভাষায় উল্কি কেন? আহমেদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, ‘‘এক বন্ধুর কাছ থেকে লেখাটা পেয়েছিলাম। আমার জানা একমাত্র ভারতীয় সংস্কৃতিতেই নাচের দেবতা রয়েছেন। আমাকে বলা হয়েছিল, নাচ চালিয়ে গেলে মেরে ফেলা হবে। গর্দানের ঠিক যে জায়গাটায় তলোয়ারের কোপ পড়ত, সেখানেই তাই আমি এই অক্ষরগুলো এঁকে নিয়েছিলাম।’’

উল্কিতে লুকিয়ে আহমেদ জুদের লড়াইয়ের গল্প।

২০১৪ সালে লেবাননে রিয়্যালিটি শো ‘সো ইউ থিঙ্ক ইউ ক্যান ডান্স’-এর চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন আহমেদ। কিন্তু প্যালেস্তাইনি বংশোদ্ভূত হওয়ায় তাঁকে বলা হয়, ‘তোমার তো কোনও দেশ নেই। তুমি ফাইনালে অংশ নিতে পারবে না।’ ‘‘তখন মনটা ভেঙে গেলেও পরে বুঝতে পেরেছি, আরব দুনিয়ার দর্শকেরা আমাকে সেই শোয়ের মাধ্যমেই চিনেছিলেন,’’ জানালেন আহেমদ।

আর আরব দুনিয়ার বাইরে? কী ভাবে এক যুদ্ধদীর্ণ দেশের ছেলে আজ পশ্চিমি দুনিয়া কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে? আহমেদের নিজের কথাতেই, ‘‘রূপকথার মতো সেই গল্প। মাঝেমধ্যে আমারই মনে হয়, সত্যিই কি এমন হয়েছিল!’’

সেটা ২০১৪ সালের কথা। সিরিয়া ঘুরে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করছেন ডাচ সাংবাদিক রুজ়বেহ কাবোলি। গিয়েছেন কয়েক হাজার বছরের পুরনো শহর পালমাইরাতে। আইএস হামলায় তত দিনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সে শহর। এক দিন দেখেন, পালমাইরার ধ্বংসস্তূপে নেচে চলেছেন এক যুবক। দর্শক— শুধু তাঁর মা। তখনই আহমেদের সঙ্গে পরিচয় হয় রুজ়বেকের। আহমেদ রুজ়বেককে জানান, পালমাইরাতে ছিল তাঁর মামার বাড়ি। আইএস জঙ্গিরা গুলি করে মেরেছে তাঁর দুই মামাকে। তার পর বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে তাঁদের বাড়ি। সেই ধ্বংসস্তূপকেই নাচের মঞ্চ বানিয়ে নিয়েছিলেন আহমেদ। নিহত আত্মীয়দের প্রতি সেটাই ছিল তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য।

তার পরের গল্প, ওই আহমেদ যা বললেন, রূপকথা!

আহমেদকে নিয়ে চারটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন রুজ়বেক। ডাচ টিভিতে সেগুলো দেখানো হয়। আহমেদের মতো শিল্পী এ ভাবে প্রাণ সংশয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন জেনে নড়েচড়ে বসে ‘দ্য ডান্স ফর পিস অর্গ্যানাইজ়েশন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাদেরই আমন্ত্রণে এবং ‘ডাচ ন্যাশনাল ব্যালেট’-এর সহযোগিতায় ২০১৬ সালে নেদারল্যান্ডসে চলে আসেন আহমেদ।

তার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ফ্রান্স, সুইৎজ়ারল্যান্ড, ইটালি, নরওয়ে, স্পেন— অনুষ্ঠান করেছেন বিভিন্ন দেশে। আহমেদের বাবা তত দিনে শরণার্থী হয়ে জার্মানিতে চলে এসেছেন। পুনর্মিলন হয়েছে তাঁর সঙ্গেও। আহমেদের কথায়, ‘‘বাবা আমার নাচে বাধা দিতেন। আমি কিন্তু তাঁর জন্য তাঁর প্রিয় বাঁশি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম।’’

নিরাপত্তার উষ্ণ ঘেরাটোপে এখন জীবন কাটছে। সন্ত্রাসের রক্তচক্ষু ছাড়াই শিল্পে গা ভাসানো যাচ্ছে। তবু উল্কি মোছেননি কেন? কম্পিউটার পর্দার ও-পারে কয়েক মিনিটের নীরবতা। তার পর ফুটে উঠল প্রত্যয়ী শব্দগুলো— ‘‘এই উল্কি আমাকে স্বপ্ন দেখায়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার স্বপ্ন। দেশে ফেরার স্বপ্ন। আবার বাচ্চাদের নাচ শেখানোর স্বপ্ন। এই উল্কি আমার অতীত। আমার ভবিষ্যতও।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.