নেওয়ার্ক বে ব্রিজের একটা ছোট্ট অংশ থেকে নিউ ইয়র্ক শহরটি দেখা যায়। আরও কাছ থেকে ভাল করে দেখার জন্য রয়েছে দূরবিন। দূরবিনে চোখ দিলেই হঠাৎ অনেক কাছে চলে আসে দূরের শহর। সে দিন যদিও গাড়ি থেকে নেমে দূরবিনে চোখ দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি।
দুর্ঘটনা নাকি প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সেটা ভাবতে ভাবতেই রেডিয়ো চালালাম। উত্তেজিত সংবাদপাঠকের বলা প্রথম যে শব্দটা কানে ধাক্কা মারল সেটা— টেররিস্ট অ্যাটাক!। সন্ত্রাসবাদী হামলা? নিউ ইয়র্কে? এ তো কল্পনার অতীত। তত ক্ষণে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছি। বুঝে গিয়েছি, ব্রিজ পেরিয়ে ও দিকে যাওয়া আজ আর সম্ভব হবে না। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৮টা ৪৯। তখনও জানি না, তার ঠিক ৩ মিনিট আগে, ৮টা ৪৬-এ একটি যাত্রিবাহী বিমান ধাক্কা মেরেছে নর্থ টাওয়ারে। তখনও জানি না, আর ১৪ মিনিট পরেই, ৯টা ৩ মিনিটে আরেকটি অপহৃত বিমান গিয়ে ধাক্কা মারবে সাউথ টাওয়ারেও। তখনও দাঁড়িয়ে ছিল টাওয়ার দু’টি। পরে বুঝতে পেরেছি, তার মানে আমি যখন দেখেছি, তখনও টাওয়ারের ভিতরে ছিলেন অসংখ্য মানুষ। মরণ-বাঁচনের মাঝখানে!
গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ফেরত চললাম বাড়ির দিকে। রোজকার পরিচিত রাস্তা হাইওয়ে ৯৫ ধরে। ভেরমন্ট-ফ্লরিডা এই ইন্টারসিটি হাইওয়ে ধরেই সব সময়ে যাওয়া-আসা করি। এত ফাঁকা কোনও দিন দেখিনি এই হাইওয়ে। পরে শুনেছিলাম, আরও জঙ্গি হামলা হতে পারে, এই আশঙ্কায় সব ইন্টারসিটি হাইওয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ।
বাড়ি ফেরার পথে ফোন করলাম স্বামীকে। সে তখনও বিশ্বাস করতে চাইছে না যে, সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে আমেরিকায়। আসলে আমাদের সকলেরই একটা যেন ধারণা ছিল— আমেরিকা দুর্ভেদ্য, অজেয় একটা দেশ। এক দিকে অতলান্তিক, আর এক দিকে প্রশান্ত মহাসাগর রক্ষা করছে দেশটিকে। আমেরিকার মাটিতে কখনও কোনও বড় মাপের যুদ্ধ হয়নি, আমেরিকা সব সময়ে অন্য দেশে গিয়ে যুদ্ধ করে এসেছে। সিনেমার পর্দায় নানা বিপর্যয়ের ছবি দেখা গেলেও বাস্তবে এখানে কিছু হবে না— মানুষের মনে এই ধারণাটা ছিল বলেই মনে হয় এখানেই আঘাত করার এই পরিকল্পনা করেছিল সন্ত্রাসবাদীরা। যাত্রিবাহী বিমান ছিনতাই করে, সেগুলিকেই অস্ত্রের মতো ব্যবহার করে যে এ রকম ভয়াবহ আঘাত হানা যায়, তা তো আমরা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি!
পরের দিন টুইন টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ থেকে থ্যাঁতলানো, ঝলসানো মৃতদেহগুলি বার করে এনে রাখা হচ্ছিল নিউ জার্সি সিটির লিবার্টি স্টেট পার্কে। এখানেই হামলার এক দশক পরে, ২০১১-এ, গড়ে তোলা হয় ‘এম্পটি স্কাই মেমোরিয়াল’। সেই স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে এক দিন হঠাৎ মনে হল, এই লিবার্টি স্টেট পার্কের অনতিদূরেই তো এলিস আইল্যান্ড। যে ক্ষুদ্র দ্বীপটিতে নাম নাম নথিভুক্ত করা হত অভিবাসীদের। ১৮৯২ থেকে ১৯২৪, এই কয়েক বছরে এক কোটি ২০ লক্ষ অভিবাসীর নাম নথিভুক্ত করা হয়েছিল এলিস আইল্যান্ডে। আমেরিকা তো অভিবাসীদেরই দেশ। একশো বছরের বেশি সময় ধরে এই দেশকে আপন করে নিয়েছেন কোটি কোটি অভিবাসী। অভিবাসীদেরও আপন করে নিয়েছে এই বিশাল দেশ।
কুড়ি বছর আগের সেপ্টেম্বরের এক সকাল বদলে দিল সেই ছবিও।