Advertisement
০৭ মে ২০২৪

সাম্রাজ্যবাদী হিংসার বিরুদ্ধে নীল আকাশের নাম

আমাদের অনেকেরই প্রথম কাস্ত্রো-পরিচয় ‘আখের স্বাদ নোনতা’ পড়ে। আর তারও বহু বছর পরে, বোধ হয় ’৭৫--’৭৬ হবে, নাকি ’৭৭, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যখন এক জাহাজ বই নিয়ে বিদেশ থেকে কলকাতায় ফিরলেন, তখন আমরা জানলাম, উচ্চারণটা ‘কিউবা’ নয় ‘কুবা’।

১৯৭৩ সালে দমদম বিমানবন্দরে জ্যোতি বসুর সঙ্গে ফিদেল কাস্ত্রো। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ থেকে।

১৯৭৩ সালে দমদম বিমানবন্দরে জ্যোতি বসুর সঙ্গে ফিদেল কাস্ত্রো। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ থেকে।

শুভাশিস মৈত্র
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ১৬:২২
Share: Save:

আমাদের অনেকেরই প্রথম কাস্ত্রো-পরিচয় ‘আখের স্বাদ নোনতা’ পড়ে। আর তারও বহু বছর পরে, বোধ হয় ’৭৫--’৭৬ হবে, নাকি ’৭৭, প্রয়াত কবি সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাদা (সম্বরণেরও) মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যখন এক জাহাজ বই নিয়ে বিদেশ থেকে কলকাতায় ফিরলেন, তখন আমরা জানলাম, উচ্চারণটা ‘কিউবা’ নয় ‘কুবা’। আমরা কেউ কেউ তখন সত্যেনের নেতৃত্বে কবিতা মকশো করছি। সে সময়ে স্পন্দন পত্রিকায় মানবদা কুবা-সহ লাতিন আমেরিকান বেশ কয়েক জন কবির কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। তখন পেঙ্গুইনের একটা বই এল বাজারে, ‘পেঙ্গুইন বুক অফ লাতিন আমেরিকান ভার্স’। আমাদের অনেকেরই ঝোলা ব্যাগে এক পাউন্ড, মানে ১৬ টাকায় কেনা সে বই থাকত তখন।

ফিরে যাই ছাত্রযুগে। প্রথম থেকেই সিগার বা চুরুট মখে ওই দাড়িওয়ালা মানুষটা ছিলেন আমাদের হিরো। আমাদের ছাত্র বয়েসে আমরা আমেরিকাকে চিনেছিলাম ভিয়েতনাম দিয়ে। উইলফ্রেড বার্চেটের ‘ইনসাইড স্টোরি অফ দ্য গেরিলা ওয়ার’ বা বারট্রান্ড রাসেলের ‘ওয়ার ক্রাইমস ইন ভিয়েতনাম’, যা পড়ে, বন্দেমাতরম স্লোগান দিয়ে একদা হস্টেল থাকে বিতাড়িত, মনেপ্রাণে প্রবল গাঁধীবাদী আমার বাবাকে দেখেছিলাম, বাড়ির উঠোনে মার্কিনি প্রকাশনার বেশ কয়েকটি বই পুড়িয়ে দিতে। আর মা পেছনে দাঁড়িয়ে গজগজ করছিলেন ছাইগুলো এ দিক-ও দিক উড়ে যাচ্ছিল বলে।

পরে ছাত্রজীবনে যখন আমাদের কারও কারও জীবন একটু বেশি বাঁয়ে ঢলে পড়েছিল, তাদের ফিদেল নিয়ে কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। বলা হত, ও সব রোম্যান্টিসিজম, কঠোর বিপ্লবী ব্যাপারস্যাপার নাকি নয়। কেন যে চারুবাবু-কানুবাবুর রাজনীতি রোম্যান্টিসিজম নয়, ফিদেল রোম্যান্টিসিজম, তার কোনও উত্তর ছিল না। তবে মনে হত, ফিদেল বা চে যেমন উজ্জ্বল দেখতে ছিলেন, চারুবাবু-কানুবাবুরা মোটেই তেমন ছিলেন না। সেটাই বোধ হয় ছিল আসল কারণ। সে সময় অবশ্য এ সব কথা বললে কপালে দুঃখ ছিল। তুলনায় সিপিআই বা সিপিএমের সঙ্গে কিউবার সম্পর্ক ছিল অনেক স্বাভাবিক। এমনকী, কংগ্রেসের সঙ্গেও। বিশেষ করে ‘নন অ্যালাইনমেন্ট’-এর কল্যাণে ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে।

১৯৭৩ সালে দমদম বিমানবন্দরে পা রাখছেন ফিদেল কাস্ত্রো।

১৯৭৩ সালে ফিদেল কাস্ত্রো কলকাতায় এসেছিলেন। জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তরা তাঁকে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন। সেই সফরে ফিদেল প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘এখানে এতগুলো কমিউনিস্ট পার্টি কেন?’’ পরে এক বার, ’৯৪-’৯৫ সাল হবে, কলকাতা বিমানবন্দরে রাত কাটিয়েছিলেন ফিদেল। সকালের বিমান ধরবেন বলে। তবে শহরে ঢোকেননি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এক বার চোখের অস্ত্রোপচার করাতে কিউবা গিয়েছিলেন। সেই থেকে সিপিএমের অনেক নেতাকেই বলতে শুনেছি, চোখের চিকিৎসায় কিউবা নাকি বিশ্বে এক নম্বর। হবে হয়তো!

কিউবা শুরুই করেছিল সোভিয়েত মডেল দিয়ে। রাশিয়া ওদের প্রভূত সাহায্য করেছে। শুধু রাশিয়া নয়, ভারত, চিন, জাপানও। কিন্তু যখন রাশিয়ায় গ্লাসনস্ত শুরু হল, গোর্বাচেভ জানিয়ে দিলেন, সাহায্য বন্ধ। রাউল ছিলেন গোর্বাচভের সমর্থক। রাউলের গুরুত্ব ছিলই, সেটা আরও বাড়তে থেকে। রাউল পরে বলেছেন, রাশিয়ান মডেল গ্রহণ করা ভুল হয়েছিল। এখন কিউবাতে প্রায় ২৫ শতাংশ প্রাইভেট ক্যাপিটালিজম স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ছোট হোটেল, ছোট দোকান ইত্যাদি। তিন থেকে পাঁচ জন কর্মচারী নিয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। খুবই গরিব দেশ। বিপুল সংখ্যক মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে জীবনযাপন করেন। ফিদেল নেতা ছিলেন সন্দেহ নেই। খুবই বড় নেতা ছিলেন। কিন্তু দূরদৃষ্টি? তার যথেষ্ট প্রমাণ রেখে গেলেন তো? ঋণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে তাঁর বইপত্র আছে শুনেছি। মার্কসবাদের তত্ত্ব নিয়ে তাঁর কোনও বই আছে শুনিনি।

কাস্ত্রো তো শুধু একটা নাম ছিল না। একটা স্বপ্ন ছিল। সাম্রাজ্যবাদী হিংসার বিরুদ্ধে একটা নীল আকাশের নাম। ১৯৯১-এ সোভিয়েতের পতনের পর সেই স্বপ্ন আর সে ভাবে বেঁচে নেই। সেই নীল আকাশ কালো মেঘে ছেয়েছে। আমেরিকার সিআইএ কাস্ত্রোকে খুন করার চেষ্টা করেছে বহু বার। পারেনি। আর পারবেও না। মরে গিয়েও কাস্ত্রো আরও এক বার আমেরিকাকে হারিয়ে দিলেন। কিন্তু কাস্ত্রোও কি জিতলেন? আদর্শের কাস্ত্রো? আমাদের আদরের ফিদেল?

আরও পড়ুন: ফিদেল কাস্ত্রো প্রয়াত

সিঁড়ি ভাঙতে স্বপ্ন ‘মেক ইন আমেরিকা’-ই

‘তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম!’ ফিদেলকে লিখেছিলেন চে

৬৩৪ বার খুন করার চেষ্টা হয়েছে ফিদেলকে?

আমেরিকার নাকের ডগায় ছোট্ট দ্বীপের স্পর্ধার নাম ফিদেল কাস্ত্রো

‘বিয়ার হাগ’ দিয়ে ইন্দিরাকে চমকে দিয়েছিলেন কাস্ত্রো

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ফিদেলের ছিল গভীর শ্রদ্ধা

কাস্ত্রোর প্রয়াণে শোকাহত বাংলাদেশ

ফিদেল কাস্ত্রোর প্রয়াণে টুইট করলেন যাঁরা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fidel Castro imperialist violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE