সাওপাওলোর রাস্তায়। ছবি- সংগৃহীত
গত চার বছর ধরে দেখছি, রাজনৈতিক টালমাটাল বেড়েই চলেছে ব্রাজিলে। বামপন্থী নেতা লুলা জেলবন্দি। অক্টোবরে ভোট। অথচ প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট লুলা ছাড়া প্রার্থী হিসেবে ব্রাজিলীয়দের আর কাউকে পছন্দই নয়। ভোট নিয়ে জনগণ যখন মহাচিন্তিত, তখনই শুরু হয়ে গেল বিশ্বকাপ। সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু ভুলে ফুটবলে মনোনিবেশ।
রাস্তা-দোকানপাট, কফি-জামা-কানের দুল-নেলপালিশ হলুদে-সবুজে ছেয়ে গেল। গাড়ি-বাড়িতে দেশের পতাকার রমরমা। রাস্তার ধারের ছোট যে বার-গুলো টিমটিম করে জ্বলছিল, বিশ্বকাপ আসতেই জনতার নজর কাড়তে বড় বড় টিভি লাগিয়ে তারাও সাজল হলুদে-সবুজে।
বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক এক সপ্তাহ আগে একটা স্টেশনারি দোকানে ঢুকেছি। চারদিকে খেলার মাঠে মজা করার হরেক জিনিস— ভুভুজেলা, পতাকা, স্কার্ফ, হলুদ-সবুজ নকল চুল। দেখি, এক ভদ্রলোক তাঁর বছর পাঁচেকের ছেলেকে নকল চুল পরিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, “পছন্দ হয়েছে? তুমি এটা পরে ব্রাজিলের খেলা দেখবে।” বাচ্চাটাকে বললাম, “কী মনে হয়, ব্রাজিল জিতবে?” ছেলেটা প্রশ্ন শুনেই ‘ফোরসা ব্রাজিল... ফোরসা ব্রাজিল’ করে তিড়িংবিড়িং নাচতে লাগল। পর্তুগিজে ‘ফোরসা’ শব্দটা ব্যবহার করা হয় শক্তিশালী কিছুকে বোঝাতে।
তখনই বুঝেছিলাম, ফুটবল-হুজুগ শুরু। সারা বছর ব্রাজিলীয়রা ক্লাব ফুটবল নিয়ে থাকেন। কিন্তু এমন হলুদ-সবুজে মাতোয়ারা হন বিশ্বকাপেই।
পুজোর বাজার করার মতোই বাচ্চাদের জন্য ভুভুজেলা, মুখোশ কেনাকাটা শুরু করে দেন বাবা-মায়েরা।
অফিসে, বাড়িতে, বাসে-ট্রেনে, এখন ফুটবল নিয়েই আলোচনা। আমি সাও পাওলোর একটি স্কুলে বিজ়নেস মার্কেটিং পড়াই। প্রতি দিন ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীরা ফুটবল নিয়ে চর্চা করবেই। তাদের বিশ্লেষণ অবাক হয়ে শুনি। কলকাতায় থাকার সময়ে ছোট থেকে আমি ফুটবলের ভক্ত ছিলাম না, পাগলের মতো কোনও দলকে যে সমর্থন করতাম, তা-ও নয়। শুধু বিশ্বকাপের সময়ে পড়ার ফাঁকে খেলা দেখতাম। এখনও যে ফুটবল বিশেষ বুঝি তা নয়, তবে কাজের অজুহাতে খেলা না-দেখে থাকার উপায় নেই!
ব্রাজিলের নিয়ম, দেশের খেলা থাকলে সর্বত্র ছুটি। কোথাও হাফ-ছুটি, কোথাও ফুল। ছুটির মেয়াদ নির্ভর করে অফিসের কর্মী সংগঠনের উপরে। দমকল, অ্যাম্বুল্যান্স, পুলিশের গাড়ি ছাড়া খেলার দু’ঘণ্টা ব্রাজিল বন্ধ। কোথাও যাওয়ার নেই, কিছু করার নেই, শুধুই ফুটবল! যাঁদের হাফ-ছুটি, তাঁরা হলুদ-সবুজ বা নীল জার্সি পরে অফিসে যান। কেউ কিন্তু একা একা খেলা দেখেন না। জড়ো হন কফি শপে, বারে, রেস্তরাঁয়, আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িতে। হার-জিত, হাসি-কান্না, সবই ভাগাভাগি করে নেন।
সাও পাওলোর স্থানীয় সময় অনুযায়ী খেলা শুরু হচ্ছে সকাল ৯টা, ১১টা অথবা দুপুর ৩টেয়। যা বুঝেছি, এই বিশ্বকাপের ব্রাজিলকে নিয়ে জনতা বেশ আশাবাদী। নেমারের আঘাত নিয়ে মশকরার বদলে মেক্সিকো ম্যাচে ভাল খেলার জন্যই লোকে গর্বিত। গত বিশ্বকাপে সাত গোল খাওয়ার লজ্জা মনে রেখে, দেশের রাজনৈতিক দুরবস্থা থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে এই মুহূর্তে এ দেশের সমস্ত মানুষের একটাই প্রার্থনা— যেন ষষ্ঠ বার বিশ্বজয়ী হয় ব্রাজিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy