হেলিকপ্টার থেকে দেখা যাচ্ছে নীচে সার সার বাড়ি। কিন্তু কোনও বাড়িতে ছাউনি নেই। দিনভর, রাতভর রোদে-জলে মাখামাখি হচ্ছে ছাউনিবিহীন গৃহস্থালীর সব সরঞ্জাম। অবশ্য সার সার এই সব বাড়িতে লোকজনও নেই। লোকজন নাকি ফিরবে ওই সব পরিত্যক্ত জনপদে। তাই স্থানীয় প্রশাসন রাস্তাঘাট বানাচ্ছে, স্কুল তৈরি করছে, তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ছাউনিহীন বাড়িগুলোতে পানীয় জল পাঠানোর ব্যবস্থাও হচ্ছে।
ঘটনাস্থল পাকিস্তানের উপজাতি প্রধান দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান। মাকিন, লাধা, কানিগুর্ম— একের পর এক জনপদ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। কিন্তু এলাকার পুনর্গঠন যে হচ্ছে, তা দেখাতেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিনিধিদের কপ্টারে চড়িয়ে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে পাক সেনা।
কেন পুনর্গঠন? আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে তা দেখানোর এত তাগিদই বা কেন? আসলে জঙ্গি দমনের নামে ওয়াজিরিস্তানের সাধারণ মানুষের উপর যে তুমুল অত্যাচার চালিয়েছে পাক সেনা, তা বিশ্বের অজানা নয়। সেই কলঙ্কই এখন মুছতে চাইছে পাকিস্তান।
তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি নামক কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠনের বাড়বাড়ন্ত সবচেয়ে বেশি ছিল ওয়াজিরিস্তানের দক্ষিণাংশেই। আফগান তালিবানকে পাকিস্তান আশ্রয় দিয়ে রেখেছে ঠিকই। কিন্তু তেহরিক-ই-তালিবানকে তারা আশ্রয় দিতে পারেনি। কারণ ওই জঙ্গিরা পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতাই দখল করতে চেয়েছিল। বায়তোল্লা মেহসুদের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই-তালিবানের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে অভিযান শুরু করে পাক সেনা। জঙ্গি খোঁজার নামে সাধারণ উপজাতি পরিবারগুলির উপরই নির্যাতন চালানো শুরু হয়। একের পর এক জনপদ থেকে প্রায় ৭২ হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। গোটা এলাকাকে ফাঁকা করে দিয়ে জঙ্গি ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করেছিলেন পাকিস্তানের সেনাকর্তারা। তাই দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের একের পর এক গ্রাম, শহর, জনপদ ফাঁকা করে দেওয়া হতে থাকে। সাধারণ মানুষের ছেড়ে যাওয়া বাড়িগুলিতে জঙ্গিরা যাতে লুকিয়ে থাকতে না পারে, তাও নিশ্চিত করতে চেয়েছিল পাক সেনা। কিন্তু তার জন্য এলাকায় টহল দেওয়া বা নিয়মিত তল্লাশি চালানোর পথ নিতে চায়নি পাক সেনা। রোজ টহল, রোজ তল্লাশিতে অনেক পরিশ্রম। তাই সব বাড়ির ছাউনি উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানের সর্বশক্তিমান সেনা। পরিশ্রম অনেক কমে গিয়েছে তাতে। হেলিকপ্টার নিয়ে বাড়িগুলির উপর এক বার চক্কোর দিয়ে এলেই এখন দেখা যায় কেউ কোথাও লুকিয়ে রয়েছে কি না। তাতে বাড়িগুলির কতটা ক্ষতি হল, গৃহস্থালীর সরঞ্জাম কতটা নষ্ট হল, তা ভাবার প্রয়োজন বোধ করেনি সেনা।
আরও পড়ুন:
আইএস জঙ্গিদের শেষ করতে ব্রিটিশদের নতুন অস্ত্র বলিউডের গান!
বেশ কয়েক বছর গোটা এলাকা ফাঁকা করে রাখার পর পাকিস্তানের প্রশাসন নিশ্চিত, জঙ্গিরা আর নেই দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে। তাই এ বার উদ্বাস্তু মানুষকে ঘরে ফেরানোর তোড়জোড়। ৪২ হাজার পরিবারকে ফেরানোর কাজ শুরু হয়েছে। আরও ৩০ হাজার পরিবারকে ফেরানো বাকি। কিন্তু যাঁরা সাত বছর উদ্বাস্তু অবস্থায় কাটিয়ে অবশেষে বাড়ি ফিরছেন বা ফিরবেন, তাঁরা পাচ্ছেন ছাউনিবিহীন বাড়ি। গ্রামে বা শহরে রাস্তাঘাট, স্কুল, হাসপাতাল যতই হোক, দীর্ঘ দিন ঘরের মাথায় ছাদ না থাকায় গৃহস্থালীর অবস্থা বেহাল। কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু কাঠামোগুলো। ঘরের ভিতরের জিনিসপত্রও সব শেষ। পাক সেনা জানাচ্ছে, বাড়ি মেরামতের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের বাসিন্দাদের। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বলছেন, যা দেওয়া হচ্ছে, তা ক্ষতির পরিমাণের তুলনায় কিছুই নয়। ক্ষোভ বাড়ছে উপজাতিদের মধ্যে।
ছাউনি বা ছাদ খুলে নেওয়া নিয়ে পাক সেনার অবশ্য কোনও আফশোস নেই। সেনাকর্তারা এখনও নিজেদের পিঠ চাপড়াচ্ছেন, জঙ্গিনিধনের এমন ‘অসামান্য’ পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy