Advertisement
E-Paper

‘নাগরিক থেকে শরণার্থী বানিয়ে দিল এই যুদ্ধ’

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বাস্তুহারা করে দিচ্ছে অসংখ্য নাগরিককে। সর্বস্ব খুইয়ে, স্বজনহারা হয়ে ঘর ছাড়ছেন তাঁরা। তাঁদেরই এক জন বাদের ইউসুফ। কী ভাবে সিরিয়া ছেড়ে গ্রিস, অস্ট্রিয়া হয়ে শেষমেশ জার্মানিতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেলেন, তারই রোমহর্ষক বর্ণনা শোনা গেল সিরিয়ার স্কুলের শিক্ষক, বছর আঠাশের ইউসুফের মুখে।সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বাস্তুহারা করে দিচ্ছে অসংখ্য নাগরিককে। সর্বস্ব খুইয়ে, স্বজনহারা হয়ে ঘর ছাড়ছেন তাঁরা। তাঁদেরই এক জন বাদের ইউসুফ। কী ভাবে সিরিয়া ছেড়ে গ্রিস, অস্ট্রিয়া হয়ে শেষমেশ জার্মানিতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেলেন, তারই রোমহর্ষক বর্ণনা শোনা গেল সিরিয়ার স্কুলের শিক্ষক, বছর আঠাশের ইউসুফের মুখে।

অন্ধকার ভবিষ্যত্। সার্বিয়া-হাঙ্গেরি সীমান্তে শরণার্থীরা। ছবি: রয়টার্স।

অন্ধকার ভবিষ্যত্। সার্বিয়া-হাঙ্গেরি সীমান্তে শরণার্থীরা। ছবি: রয়টার্স।

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ১৬:১৩
Share
Save

পর পর তিন বার! গ্রিসের নৌকোয় উঠতে ব্যর্থ হয়েছিলাম।

একে তো সমুদ্রে বিশাল ঢেউ। তার উপর পালাতে চাওয়া মানুষের ভিড়! দুয়ে মিলে টলমল নৌকোর অনেকগুলিই ডুবেছে সাগরের জলে! আর এর মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় আমাকে। তার পর জেলে পুরে রাখা হয় তিন সপ্তাহেরও বেশি।

শেষমেশ কোনওক্রমে গ্রিসের একটা দ্বীপে এসে পৌঁছেছিলাম। স্থানীয় থানায় পৌঁছতে প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছিল। পৌঁছে দেখি, আমার আগেই সেখানে সার বেধে দাঁড়িয়ে অসংখ্য শরণার্থী। কি বিশাল লাইন! পুলিশ যাবতীয় তথ্যাদি নিয়েছিল। তার পর নির্দেশ দেয়, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরা যেন গ্রিস ছেড়ে চলে যাই! সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম যেতে হবে আথেন্স। সেখান থেকে বাসে ম্যাসিডোনিয়ার সীমান্ত। একটা ছোট জাহাজে কোনও রকমে জায়গা পেয়েছিলাম। আথেন্স যেতে জনপ্রতি ভাড়া লেগেছিল ৪৭ ইউরো!

আথেন্স থেকে যে বাসে আমরা ম্যাসিডোনিয়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেটিকে হঠাত্ই পুলিশ তাড়া করে। প্রথমে বুঝিনি। পরে জেনেছি, বাসচালক ভুল পথে যাচ্ছিলেন। পুলিশ আমাদের সবাইকে থানায় নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখি, সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টায় সিরিয়ার অসংখ্য শরণার্থীকে আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে।

এর পর প্রায় ৪৮ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। শুনেছি, সার্বিয়ার পরিস্থিতি বেশ ভাল। আমরা সার্বিয়ার ট্রেনে চাপি। সেখানে পৌঁছে দেখি, শরণার্থীদের সাহায্য করতে সীমান্তে প্রচুর অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে। উদ্বাস্তুদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছিল পানীয় জল এবং খাবার। এর পর আমরা অনেক হেঁটেছি। কত ক্ষণ, তার আর হিসেব রাখিনি। শেষে একটা মসজিদে পৌঁছেছিলাম। রাতটা কাটিয়েছিলাম সেখানেই। পরে যখন বেলগ্রেড পৌঁছই, হোটেলে থাকার জন্য সেখানে দিতে হয়েছিল ৩০ ইউরো। সেখান থেকে হাঙ্গেরি সীমান্ত গিয়েছিলাম। দালালরা সেখানে আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল বোধহয়! তাদেরই এক জন আমাকে বলেছিল, ‘‘তুমি যদি আমার সঙ্গে বুদাপেস্ট যেতে চাও তবে এক হাজার ইউরো দিতে হবে।’’

এর পর অনন্ত পথ হেঁটেছি! ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধুই হাঁটা আর হাঁটা। ঘন জঙ্গল পথে সেই হাঁটার শেষে আমাদের জন্য একটি গাড়ি রাখা ছিল। তাতে করেই পৌঁছেছিলাম রাজধানীতে। সেখান পৌঁছে যে হোটেলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি চালান এক জাপানি ভদ্রমহিলা। আমাদের দেখেই বলেছিলেন, ‘‘আমার এখানে কোনও ঘরই খালি নেই। তবে, হোটেল লাগোয়া ওই বাগানে রাতে শুতে পারেন। সে ক্ষেত্রে প্রত্যেককে ১০ ইউরো করে দিতে হবে!’’

দ্বিতীয় দিন সেই দালালটি এল। বলল, ‘‘তুমি কি জার্মানি যেতে চাও! তা হলে আরও ৬০০ ইউরো দিতে হবে কিন্তু।’’ সে ক্ষেত্রে আমাদের নাকি একটি অত্যাধুনিক বাসে করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হবে! রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ আমরা জার্মানিতেই থিতু হতে চাইছিলাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছে সে দেশে শরণার্থী হওয়ার আবেদন জানাতে পারাটাই তখন মূল লক্ষ্য। আর রাজি হওয়ার পর থেকে বাসের জন্য তর সইছিল না যেন! অবশেষে যখন বাস এল, দেখলাম তার একটি আসনও খালি নেই। কিন্তু, আমাদের তো যেতেই হবে। তাই বাসের মেঝেতেই বসে পড়েছিলাম। প্রথমেই চোখ গিয়েছিল চালকের দিকে। ভদ্রলোকের বয়স সত্তরের উপর তো হবেই! তার উপরে তিনি যে মদ্যপ অবস্থায় রয়েছেন, সেটা বুঝতে এক মিনিটও সময় লাগেনি। এমনকী, তিনি যে ঠিকমতো রাস্তাও চেনেন না সেটাও ধরা পড়ে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। আর এই পরিস্থিতিতে যা হওয়ার, তাই হয়েছিল। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আমাদের বাস। কাজেই অস্ট্রিয়াতেই বাসটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই!

এর পর জার্মানির জন্য একটা ট্রেনে চড়েছিলাম বটে, কিন্তু পুলিশ গ্রেফতার করে আমাদের। অস্ট্রিয়া পুলিশের হাতে তিন দিন জেলবন্দি অবস্থাতেই কাটাতে হয়। পরে তারা দু’টি প্রস্তাব দেয় আমাদের। ভুল বললাম, প্রস্তাব নয়, নির্দেশ! হয় তাদের কাছে আঙুলের ছাপ দিতে হবে, নয়তো সে দেশেই শরণার্থী হওয়ার আবেদন জানাতে হবে। আমি দু’টির কোনওটিতেই সম্মত হতে পারিনি। কাজেই ওদের প্রস্তাব পত্রপাঠ ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। ওরাও আর দেরি করেনি। পিছনে এক প্রকার লাথি মেরেই আমাদের হাঙ্গেরির সীমান্তে পাঠিয়ে দেয়।

সেখানে পৌঁছেও দেখি দালালের অভাব নেই। তাদের এক জনকে ধরে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলাম কোনও রকমে। সেই গাড়িতে উঠে পরিচয় হয়েছিল আরও এক সিরীয় পরিবারের সঙ্গে। তাঁরাও জার্মানি যাচ্ছিলেন। দালালটি আমার কাছ থেকে নিশ্চিত এবং নিরাপদ সফরের জন্য ৬০০ ইউরো অতিরিক্ত নিয়েছিল।

এখন আমি জার্মানির একটি শরণার্থী শিবিরে রয়েছি। আমার সঙ্গে অসংখ্য সিরীয়, ইরাকি, আফগানি, পাকিস্তানি নাগরিক, থুড়ি, শরণার্থী রয়েছেন। এই শিবিরে দিনে তিন বার আমাদের খেতে দেওয়া হয়। অন্য একটি শরণার্থী শিবিরে আমাদের খুব শীঘ্রই স্থানান্তর করা হবে। আপাতত তারই অপেক্ষায় আছি। পাশাপাশি, শরণার্থী হতে চেয়ে আবেদন করতে হবে বলে এখানকার আদালত কবে ডেকে পাঠায় তার জন্যও দিন গুনছি। তবে, একটা কথা! জার্মানরা সত্যিই ভীষণ উদার এবং মানবিক। আমার এই ইউরোপ সফরে যতগুলি দেশ অতিক্রম করেছি তার মধ্যে তো বটেই।

syrian civil war syria civil war refugee syria citizen bader yusuf syria school teacher bashar al asad syria violence syria unrest syria war

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}