গ্রিসের গণভোটের রায় ‘না’। কিন্তু অধুনা নয়, ক্ষমতার বিরুদ্ধে ‘না’-এর এই উচ্চারণ রয়ে গিয়েছে গ্রিসের ইতিহাসেই। কোনও ধরনের দাসত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তো গ্রিসের রক্তে!
অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গ্রিসের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়ে গ্রিক যোদ্ধারা অটোমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করার বদলে বিষ্ফোরক দিয়ে নিজেদের উড়িয়ে দিতেন। মহিলারা ক্রিতদাসী হওয়ার থেকে মৃত্যুবরণকে শ্রেয় মনে করতেন। এমনকী সন্তানদেরও পর্বত চূড়া থেকে ফেলে দিতেন। যাতে তারাও দাস হয়ে বেঁচে না থাকে। নতুন ঋণের শর্তগুলির মধ্যে দাসত্বের বার্তাই যেন পেয়েছিলেন গ্রিসের নাগরিকরা। এই গ্রিসই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মাথা নুইয়ে মুসোলিনির সন্ধির প্রস্তাব মানেনি। ফলে মুসোলিনির আক্রমণ। গ্রিসের প্রতিরোধে প্রথমে বেশ খানিকটা পিছুও হটেছিলেন মুসোলিনি। পরে অবশ্য জার্মানি গ্রিস দখল করে।
প্রজন্মের পরে প্রজন্ম ধরে গ্রিসের জনগণের মধ্যে প্রতিরোধের প্রবণতা সঞ্চারিত হয়ে আসছে। ছোটরা এই সব প্রতিরোধের কাহিনি শুনতে শুনতেই বড় হয়। স্কুল-পড়ুয়াদের বেশ কয়েক জনকে তাই ‘না’ ভোটের পক্ষে প্রচারে দেখা গিয়েছিল। পদক্ষেপ ঠিক না ভুল, এর থেকেও বড় হয়ে উঠেছে মাথা না নোয়ানোর দৃঢ়তা। পাঁচ বছরের বিভিন্ন হতাশার থেকেও অন্যের শর্ত না মানার জেদটাই বড় হয়ে উঠেছিল। এই জেদ কখনও গ্রিসকে জিতিয়েছে, কখনও হারিয়েছে। কিন্তু জেদ, প্রতিরোধ হারায়নি। রবিবার হাজার হাজার মানুষ আথেন্সের পথে একটি কথাই বার বার করে বলেছেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা বড় কথা নয়, সময় এসেছে প্রতিরোধের। অটোমান, মুসোলিনির পরে এ বার প্রতিরোধ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দাদাগিরির বিরুদ্ধে।
এই জনগণের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছেন বর্তমান শাসকরা। গ্রিসের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রক্তঝরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন বর্তমান শাসকদের মধ্যে অনেকেই। আলোচনার টেবলে তাই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিশাল চাপের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোটা প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস বা সদ্য প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিসের কাছে সহজ হয়েছিল। সঙ্গে ছিল আম-জনতার ইচ্ছাকে সম্মান দেওয়ার সাহস। কারণ, আবার ইতিহাস বলছে, শুধু উত্তরাধিকার সূত্রে রাজা নির্বাচন নয়, দেশের শাসন ভার কার হাতে যাবে, সে ক্ষেত্রে যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে দেশের জনগণের— এই ধারণার সূচনা কিন্তু হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসেই। এখানেই গড়ে উঠেছিল ‘পোলিস’ নামে নগর রাষ্ট্র। এর উল্লেখ স্বয়ং প্লেটোর ‘দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থে রয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ হল, রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, ভোটাধিকারের মতো অতি আধুনিক ধারণাগুলি যখন স্পষ্ট রূপ পায়নি, তখনও পোলিস স্বীকৃতি দিয়েছিল জনতার ভোটাধিকারকে। ছোট ছোট ওই নগররাষ্ট্রের বাসিন্দারাই পাহাড়ের পাদদেশে মিলিত হয়ে সভার মাধ্যমে রাজা নির্বাচন করতেন।
ফলে এমন চরম আর্থিক সঙ্কটের মুহূর্তে দেশবাসীর উপরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দিতে পেরেছে ইতিহাসের দেশ গ্রিস। উজ্জ্বল হয়েছে ইতিহাস।