সাত বছর বয়সেই বাবাকে হারিয়ে মায়ের কাছে মানুষ হয়েছিল মেয়েটি। পৃথিবীর কোটি কোটি সাধারণ মানুষের ভিড়েই হারিয়ে যেতে পারত সে। কিন্তু সেই অখ্যাত মেয়েটিই ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন বিশ্বজননী!
আর আজ ভ্যাটিকান সিটিতে এসে দেখছি, এই শহর-রাষ্ট্র প্রস্তুত সেই বিশ্বজননীর জন্য। ৪ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে মা টেরিজা সন্ত হতে চলেছেন।
এন্টালির জোড়া গির্জার বিপরীতে ৫৪এ জগদীশচন্দ্র বসু রোডের ছাইরঙা চারতলা বাড়িটা থেকে টাইবার নদী-তীরে রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের এই কেন্দ্রে সন্ত হয়ে ওঠার কাহিনি যেন স্বপ্নের মতো। মনে হচ্ছে, কলকাতা যেন আজ এই গথিক স্থাপত্যের শহরে এই ক্যাননাইজেশন বা সন্তায়নের কাহিনির মধ্যে দিয়ে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করছে। যার সাক্ষী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর প্রতিনিধিদল।
তবে ভ্যাটিকানে সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশের বক্তব্য, মা টেরিজাকে এই সন্ত-স্বীকৃতি দিয়ে গোটা প্রক্রিয়াটিকেই নাকি লঘু করে দেওয়া হচ্ছে। তিনি নাকি এই স্বীকৃতির যোগ্য নন। বিষয়টি নিয়ে অবশ্য মুখ খোলেননি পোপ। ভ্যাটিকানে পোপ গণমাধ্যমের কাছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সমালোচিত হবেন, এটাই এখানকার দস্তুর। সেই সমালোচনার তালিকায় এ বার সংযোজিত হয়েছে মাদার টেরিজার সন্ত হওয়ার প্রসঙ্গও।
সন্ত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ক্যাননাইজেশন। এমনিতে ছিমছাম, চুপচাপ এই ভ্যাটিকান সিটি। কিন্তু এখন সর্বত্র চলছে কর্মযজ্ঞ। তাই খুব ভিড় এ শহরে। পর্যটক থেকে জিপসির দল রাস্তায় রাস্তায়।
মা টেরিজা। পাসপোর্টে নাম ছিল, মাদার টেরিজা বোজাজিউ। জন্ম যুগোস্লাভিয়ার স্কপিয়েতে। ছোট শহর। অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত আলবেনিয়া রাজ্যে। বাবা ছিলেন ধনী ঠিকাদার। আঠারো বছর বয়সে সিদ্ধান্ত নিলেন সন্ন্যাস নেওয়ার। পথ চলার সেই শুরু, আলবেনিয়া
থেকে কলকাতা।
ক্যাননাইজেশন আজকের ব্যাপার নয়। রক্ষণশীল রোমান ক্যাথলিক পাদ্রিদের এ এক জবরদস্ত নিয়মের বাঁধনে রাখা বিষয়। এমন কোনও ব্যক্তিকে তাঁরা বাছেন, যিনি যিশুর ইচ্ছায় আর্তের সেবা করেছেন। যদি জানা যায় যে তিনি অলৌকিক বা ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তবে তাঁকে মৃত্যুর পাঁচ বছর পর এই স্বীকৃতি দেন ভ্যাটিকান সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পোপ। এ ক্ষেত্রে পোপ চাইলেই কাউকে বেছে নিতে পারেন না। বরং সন্ত স্বীকৃতি দেওয়ার আগে নামটি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তর পেরোতে হয়।
মা টেরিজার মৃত্যু ১৯৯৭ সালে। পোপ ফ্রান্সিস সন্তায়নের জন্য তাঁর নাম গত ১৫ মার্চ ঘোষণা করেছেন। ২০০৩ সালে সন্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার একটি ধাপ ‘বিয়টিফিকেশন’ স্তরে প্রবেশ করে তাঁর নাম। সে-বছর পোপ দ্বিতীয় জন পল প্রথম বার মাদারের অলৌকিক ক্ষমতার কথা জানান। বলা হয়, দক্ষিণ দিনাজপুরের মনিকা বেসরা নামের এক উপজাতি মহিলার দীর্ঘদিনের টিউমার সারাতে যখন সব চিকিৎসকই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন তিনি টেরিজার কথা ভেবে পেটের উপর একটা ক্রসের ছবি রেখে প্রার্থনা করতে করতে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
দ্বিতীয় অলৌকিক ঘটনাটি ঘোষণা করেন পোপ ফ্রান্সিস, ২০১৫ সালে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্রাজিলের এক বাসিন্দা জানান, ২০০৮ সালে তাঁর টিউমার সেরেছে মা টেরিজার জন্য। ব্রাজিলবাসী ওই রোগী অবশ্য কোনও দিন মাদারকে দেখেননি।
ক্যাননাইজেশনের এই অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্কও হয়েছে। বই লিখে ভ্যাটিকান সিটির অনুষ্ঠান সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন কেউ কেউ। অভিযোগ, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে চার্চের ‘হোলি ইয়ার অব মার্সি’ শেষ হতে চলেছে । তাই পোপ তাড়াহুড়ো করে আরও অনেককে সন্ত ঘোষণা করতে চাইছেন। অনেকে তো এমনও অভিযোগ করেছেন যে, এই সন্ত তৈরির পিছনেও রয়েছে ভ্যাটিকান সিটির অর্থনীতি। ধনী স্পনসরদের প্রভাব প্রতিপত্তিতেই নির্ধারিত হয় নতুন সন্তদের নাম।
ধর্মপ্রতিষ্ঠানকে নিয়েই মাঝেমাঝেই নানা অভিযোগ সামনে চলে আসে। কিন্তু এ যে নীল পাড় সাদা শাড়ির এক ক্ষুদ্রকায় অশক্ত চেহারার নারীর কাহিনি! ১৯৪৮ সালের ১৮ অগস্ট যিনি তাঁর বিশ বছরের আশ্রয়স্থল লরেটো কনভেন্ট ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন হাতে মাত্র পাঁচটা টাকা নিয়ে। সে দিন তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন মিশনারিজ অব চ্যারিটি স্থাপনের। আজ বিশ্বের ১৩৩টি দেশে ৪৭০টি সেবাস্থলে কাজ করছেন সেই নারীর তৈরি প্রতিষ্ঠানের ৪৭১০ জন সন্ন্যাসিনী।
এটাই এক অলৌকিক ঘটনা নয় কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy