ধ্বংসস্তূপে একা। কাটেলডাঁড়া গ্রামে মঙ্গলবার দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।
পাহাড়ের মাথায় প্রবীণ গাঁওবুড়োর বসার মেজাজটুকু এখনও দিব্যি রাজকীয়।
তিন দিক খোলা ঘরের মেঝেয় ভাবলেশহীন চোখে সবুজ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ৯৩ বছরের ভীমকান্ত কাটেল। ঘর বলতে একদিকে কাঠের দেওয়ালের ভগ্নাংশ। ছাদবিহীন পাশের ঘরে এখনও উল্টে পড়ে সাধের পোর্টেবল টিভি, উপুড় হয়ে আয়না-বসানো স্টিলের আলমারি। একতলায় বিছানার উপরে ঝুলছে নাতবৌয়ের চুল বাঁধার বাহারি ‘ধাগা’। ধসে যাওয়ার আগে কোনও মতে টিকে থাকা বাড়ির মাথায় চড়ে বৃদ্ধের এই বসে থাকায় প্রমাদ গুনছেন তাঁর আত্মীয়কুল। কিন্তু কাটেলডাঁড়া গ্রামের প্রবীণতম মানুষটিকে কে বোঝাবে সেটা!
শুধু এ বার নয়, গত শতকের ’৩৪ সালে নেপালের ইতিহাসের ভয়ালতম ভূমিকম্পের সাক্ষী ভীমকান্ত। নেপালি ‘ঢাকা-টুপি’ পরা মাথা নাড়তে নাড়তে মৃদু স্বরে বলেন, ‘‘তখন আমি ১২ বছরের ছেলে! সে-বারও কিন্তু এ গাঁয়ে দু’টোর বেশি বাড়ি ধসেনি।’’ আর এ বার সে গ্রামে বড়জোর দু’তিন খানা বাড়ি টিকে রয়েছে। রিখটার স্কেলের মাপ যা-ই বলুক, ভয়াবহতায় এই ২০১৫-কে ১৯৩৪-এর থেকেও এগিয়ে রাখছেন গ্রামের ত্রিকালদর্শী ‘হাজুরবা’ তথা ঠাকুরদা ভীমকান্ত। তবু নিজের বাড়ি থেকে নড়ার নামগন্ধ নেই।
এখনও মাঝেমধ্যেই হাল্কা কাঁপুনিতে নিজের উপস্থিতি টের পাইয়ে চলেছে মাটির নীচের দৈত্য। রাতটুকু কেউ ছাদের নীচে থাকার সাহস পান না গোর্খা জেলার সদরে। তাঁবুর নীচে বুড়োকে শোওয়াতে রীতিমতো ধরেবেঁধে নিয়ে যেতে হয়। ভীমকান্তের নাতি অনিল বলছিলেন, হাজুরবাকে নিয়ে মহা সমস্যার কথা! সকাল হলে ফের যে কে সেই! তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে ভীমকান্ত কারও সাহায্য ছাড়াই পাহাড়ি ঢাল বেয়ে টুকটুক হেঁটে নিজের বাড়িতে চড়ে বসবেন। গোটা গ্রামের ধ্বংসস্তূপে ওই দেড় তলায় মিনারের চুড়োর মতো জেগে বলিরেখা ভরপুর সেই ক্লান্ত, শীর্ণ অবয়ব।
ভূমিকম্পের ধাক্কায় গোটা নেপালের সব চেয়ে বিধ্বস্ত জেলা গোর্খায় মঙ্গলবার সকালে এই ভগ্নস্তূপে ঢুকতেও নাজেহাল হতে হল।
সবে জেলা সদর পেরিয়ে পাহাড়ি খাড়াইয়ে কিলোমিটার চারেক পাথুরে রাস্তায় আধখানা গিয়েই প্রস্তর ব্যূহে থমকে গেল গাড়ি। চালকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাথর সরিয়ে বাকিটুকু হেঁটেই উঠতে হল উপরে। কাটেলডাঁড়া আদপে উপাধ্যায় ব্রাহ্মণদের গ্রাম। বারো আনা বাসিন্দার রুটিরুজিই চাষবাস। সেই গ্রামের শতকরা ৯০ ভাগ বাড়িই এখন হয় ধূলিসাৎ, নয়তো সিকিখানা বা আধখানা হয়ে টিকে রয়েছে। তবু প্রাণহানির নিরিখে নিজেদের ঢের বেশি ভাগ্যবান মনে করছেন এ গ্রামের লোকজন। ‘‘ভাগ্যিস এটা কাঠমান্ডু নয়! এখানে অত আট-দশ তলা বাড়ি থাকলে আমরাও সকলেই এখন মাটির নীচে থাকতাম!’’— বললেন আর এক ঘরহারা প্রবীণ হরিকৃষ্ণ কাটেল।
ভূমিকম্পে ভেঙে যাওয়া গ্রামের জলের পাইপ বহু কষ্টে সারিয়ে ফেলেছেন বাসিন্দারাই। এ গ্রামে থাকতে বুক কাঁপলেও এর বাইরে অন্য বিকল্পও কেউ ভেবে উঠতে পারছেন না। তবে সবারই ক্ষোভ, শনিবার প্রথম ভূমিকম্পের পরে ৭২ ঘণ্টা কেটে গেলেও এখনও অবধি প্রশাসনের তরফে এ গাঁয়ে কারও পা পড়েনি।
পড়বেটা কী করে? এর থেকেও বিপন্ন আরও বহু প্রান্তিক জনপদ তো এখনও অবধি সভ্যতা থেকেই বিচ্ছিন্ন। গোর্খার হেলিপ্যাডে দাঁড়িয়ে এ দিন দুপুরে অসহায় ভঙ্গিতে নেপালি সেনাবাহিনীর কর্নেল শৈলেন্দ্র থাপা সেটাই বলছিলেন। ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দুর গা ঘেঁষে বারপাক, লারপাক বা শোরপানিতে পৌঁছতে সেনাবাহিনীও হিমসিম। অথচ সেখানে এখনও মাটির নীচে চাপা পড়ে রয়েছে মানুষ। সরকারি হিসেবেই এ দিন বিকেলে পর্যন্ত শুধু গোর্খা জেলাতেই মৃতের সংখ্যা ২৫০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। চিকিৎসার অভাবে বহু জখম অসহায় ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন।
কর্নেল থাপা বলছিলেন, গোর্খার জেলা সদর থেকে শোরপানি মোটে ৫০ কিলোমিটার। কিন্তু বালুয়া অবধি যাওয়ার পরে ধসে রাস্তা খতম। আমরা সেনারাও হেঁটে ওইটুকু পেরোতে পারিনি। হেলিকপ্টারে ত্রাণ পাঠাতেও ঘোর সমস্যা। ভারতীয় বায়ুসেনার কপ্টারগুলি তুলনায় বড়। কিন্তু ছোট হেলিপ্যাডে নামতে না-পেরে ফিরে যাচ্ছে। ‘‘অগত্যা খান তিনেক কপ্টার নিয়েই গোর্খা জেলায় ত্রাণ পাঠানোর লড়াই চালাচ্ছি,’’— শোরপানিগামী কপ্টারে ত্রাণ পাঠানোর তদারকি করতে করতে বললেন চিফ ডিস্ট্রিক্ট অফিসার উদ্যোগপ্রসাদ তিমোনসিমা।
দুপুর থেকে ফের বৃষ্টি দুর্যোগে শোরপানি, বারপাকের আহত-অশক্তদের কপ্টারে গোর্খায় আনার ফাঁকেই দেখা বারপাকগামী যোগবাহাদুর গুরুঙ্গ আর স্বামী-স্ত্রী গোবিন্দ ও রেণু তিওয়ারির সঙ্গে। ভূমিকম্পের খবর পেয়ে শনিবারের বিকেলেই পুণের হোটেলের চাকরি ছেড়ে মরিয়া ভঙ্গিতে ঘরে ফেরার চেষ্টায় যোগবাহাদুর। উত্তরপ্রদেশ সীমান্ত দিয়ে নেপালে ঢুকে গোর্খা অবধি পৌঁছে বাসের জন্য হা-পিত্যেশ করছেন। তিওয়ারি দম্পতিও নেপালের অন্য প্রান্তে লাপুং থেকে বারপাকমুখী। সঙ্গে বাহন থাকলেও সানুটের পর এগোনো অসম্ভব। ঘণ্টা তিনেক হেঁটেও তবু বাকি পথটুকু পেরোতে তাঁরা মরিয়া। ভূমিকম্প-ধ্বস্ত এলাকায় রেণুর বাবার সঙ্গে দেখা হবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই।
গোর্খা জেলা সদরে সাবেক নেপালরাজ পৃথ্বীনারায়ণ শাহের স্মৃতিধন্য সংগ্রহশালাটিও ভূমিকম্পের ঝাপটে ক্ষতিগ্রস্ত। জেলার পুরএলাকায় কৃষ্ণবাহাদুর খাড়কার স্ত্রী-পুত্রের দুর্গতির কথাও মুখে মুখে ফিরছে মহল্লায়। কৃষ্ণের স্ত্রী সঙ্গীতাকে তা-ও দু’ঘণ্টা বাদে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে জ্যান্ত উদ্ধার করা গিয়েছে। ছ’ঘণ্টা বাদে হদিস মেলা কৃষ্ণ-সঙ্গীতার ১৪ মাসের দুধের শিশুটির দেহে প্রাণ ছিল না। ত্রাণ নিয়ে অভাব-অভিযোগ, হইচইয়ে থম মেরে বসে থাকেন ২২ বছরের সন্তানহারা সঙ্গীতা। তবু তাঁকে নিয়েই বা কার ভাবার সময় আছে এখন!
নিত্য বিপদের হাতছানি ও অগুনতি প্রাণবলির আবহে এ সব খুচরো শোক নিছকই বিলাসিতা এই মৃত্যুর দেশে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy