Advertisement
১০ জুন ২০২৪
মেক্সিকো

গুপ্তহত্যার শঙ্কা, ছাত্রদের দেহ সন্ধানে বাবা-মা

জঙ্গলের রাস্তায় বসে আগাছা হাতড়াচ্ছিলেন ৫৪ বছরের বৃদ্ধ। দেশলাইয়ের পোড়া কাঠি, খালি জলের বোতল যা হাতে পাচ্ছিলেন যত্ন করে কাঁধের ব্যাগটায় গুছিয়ে রাখছিলেন। আশপাশে তখন বহু মানুষের ভিড়। সকলেই পঞ্চাশোর্ধ্ব। জঙ্গলের আলো-আঁধারি রাস্তায় নিরন্তর কী যেন খুঁজে চলেছেন তাঁরা। রাস্তায় পড়ে থাকা পচে যাওয়া পাতাগুলো সরিয়ে একটা কার্তুজ খুঁজে পেলেন এক মহিলা। হাত তুলে সেটা দেখাতেই খানিক ক্ষণের জন্য থমকে গেলেন তাঁর সঙ্গীরা।

সংবাদ সংস্থা
ইগুয়ালা শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০৯
Share: Save:

জঙ্গলের রাস্তায় বসে আগাছা হাতড়াচ্ছিলেন ৫৪ বছরের বৃদ্ধ। দেশলাইয়ের পোড়া কাঠি, খালি জলের বোতল যা হাতে পাচ্ছিলেন যত্ন করে কাঁধের ব্যাগটায় গুছিয়ে রাখছিলেন। আশপাশে তখন বহু মানুষের ভিড়। সকলেই পঞ্চাশোর্ধ্ব। জঙ্গলের আলো-আঁধারি রাস্তায় নিরন্তর কী যেন খুঁজে চলেছেন তাঁরা। রাস্তায় পড়ে থাকা পচে যাওয়া পাতাগুলো সরিয়ে একটা কার্তুজ খুঁজে পেলেন এক মহিলা। হাত তুলে সেটা দেখাতেই খানিক ক্ষণের জন্য থমকে গেলেন তাঁর সঙ্গীরা। তার পর ফের শুরু হল সন্ধান। কেউ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ছেন, কেউ আবার আর একটুখানি এগিয়েই ফিরে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে ক্লান্তি কাটাচ্ছেন।

ওই দলের সঙ্গে থাকা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য বললেন, “ওঁরা মরীচিকার খোঁজ করছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে ওঁদের প্রত্যেকের ছেলে-মেয়েরা কলেজে গিয়েছিল। তার পর আর ফেরেনি। আমরা সবাই মনে মনে জানি, ওই বাচ্চাগুলো আর বেঁচে নেই।” মেক্সিকোর গুয়ের্রিরোর জঙ্গল হাতড়ে হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের মৃতদেহের খোঁজ করছেন তাঁদের বাবা-মায়েরা। প্রমাণ খুঁজছেন, যাতে সরকারবিরোধী স্লোগান দেওয়ার অপরাধে ছাত্রহত্যাকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্তত একটা প্রমাণ পাওয়া যায়!

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে রাষ্টের নীতির বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন রাউল ইসেরদো রুরাল কলেজের পড়ুয়ারা। মিছিল করে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছিলেন। বিক্ষোভ থামায় পুলিশ। ব্যাপক পুলিশি প্রতিরোধের পর বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ৪৫ জন নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। আজও সন্ধান মেলেনি তাঁদের। ওই দিন ঠিক কী হয়েছিল, তা নিয়ে পরিষ্কার করে কিছুই জানানো হয়নি। সরকারি মুখপাত্রেরা তো মুখে কুলুপ এঁটেছেনই, পাশাপাশি, স্থানীয় সংবাদমাধ্যমও বিস্তারিত তথ্য সম্প্রচার করেনি। এমনকী, প্রাথমিক ভাবে নিখোঁজ সন্তানদের কথা জানিয়ে পুলিশের কাছে কোনও আবেদনও করেননি ওই ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের লোকজন। কারণ, সরকারবিরোধী স্লোগান ঠেকাতে ওই বিক্ষোভের দিন তৎপর হয়েছিল পুলিশ। ফলে তাদের কাছেই ছেলেমেয়েদের হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগ দাখিল করার ভরসা পাননি বাবা-মায়েরা।

দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর অবশেষে ভয় কাটিয়ে কয়েক জন নিখোঁজ ছাত্রের পরিবারেরা একত্রিত হন। নভেম্বরের শেষের দিকে ইগুয়ালার একটি গির্জায় সাত জন নিখোঁজ পরিবারের বাবা-মায়েরা দেখা করেন। হারানো ছেলেমেয়েদের খোঁজে কী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনাও করেন। ধীরে ধীরে তাঁদের দেখানো রাস্তায় চলতে শুরু করেন আরও অনেকে। পরের বেশ কয়েক দিন ধরে ওই গির্জায় জড়ো হতে শুরু করেন হারিয়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের পরিজনেরা। তাঁদের নৈতিক সমর্থন দিতে এগিয়ে আসেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাও। আসেন ওই ঘটনার আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষের পরিবারের সদস্যেরাও। সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে বাবা-মায়েরা ঠিক করেন, ছেলেমেয়েদের সন্ধানে নামবেন তাঁরা নিজেরাই। তবে ছেলে মেয়েরা যে আর বাড়ি ফিরবে না, তা মনে মনে মেনেই নিয়েছেন তাঁরা। এখন শেষ বারের মতো সন্ধান। অন্তত সন্তানের মৃতদেহটা যদি দেখতে পান! না হলে ছেলের ফিরে আসার আশাটা তো কিছুতেই মরছে না! নৈতিক সমর্থন পেয়ে হারানো মনের জোর বেশ কিছুটা ফিরে পেয়েছেন তাঁরা। ৩০ বছরের সিজারের বাবা সোতেলো কাস্তেন্দ্রার কথায়, “নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। ঘুম আসে না। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওঁদের সাহায্যেই সন্তানের দেহ হাতড়ে বেরাচ্ছি!”

একটি মানবাধিকার সংস্থার সদস্য মিগুয়েল জিমেনেজের কথায়, “শুধু ওই ছাত্রছাত্রীরাই নয়, হাজার হাজার মানুষ এ দেশে রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে যায়। কেউ এগিয়ে এসে অভিযোগ করে না।” তিনি জানালেন, সরকারি তথ্য অনুসারে, ২৩ হাজার মানুষ বর্তমানে নিখোঁজ। সেপ্টেম্বরে যা হয়েছে তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং দীর্ঘদিন জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তাঁর কথায়, “সরকারের পুলিশ ওই ছাত্রছাত্রীদের হত্যা করেছে বলেই জনমানসে ধারণা তৈরি হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই নিয়ে কাজ করছে। তবে সরকারতো নিশ্চুপ।

২২ বছরের সন্তানের দেহ খুঁজতে এসেও একফোঁটা চোখের জল ফেলেননি জোভিতা ক্রুজ। তাঁর কথায়, “আমাদের ছেলেমেয়েদের তো খুঁজতে হবে। ওদের শেষকৃত্য করা বাকি আছে। এখন কান্না কীসের? ছেলের দেহটা কফিনবন্দি করে তবেই মন খুলে কাঁদতে পারব!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

iguala raul iserdo rural college mexico
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE