Advertisement
০৩ মে ২০২৪

গায়ে ছিটকে আসছিল বন্ধুদের রক্ত

তেরো বছরের ছেলেটার হাত ফুঁড়ে দিয়েছে দু’-দু’টো গুলি। মস্ত বড় হলঘরটা জুড়ে তখন রক্তের বন্যা। বন্ধুদের দেহের ছোট ছোট টুকরো ছুটছে এ-দিক ও-দিক। তারই কিছু ছিটকে আসছে ছেলেটার গায়ে, মুখে। গড়িয়ে পড়ছে বন্ধুদের রক্ত। পেশোয়ারে সেনা স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র এহসান এলাহি। বুধবার তার কথা থেকেই অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে হামলার প্রকৃত ছবিটা।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে পড়ুয়াদের বই-খাতা এবং জুতো। আর্মি পাবলিক স্কুলের রক্তাক্ত অডিটোরিয়ামে।  ছবি: রয়টার্স।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে পড়ুয়াদের বই-খাতা এবং জুতো। আর্মি পাবলিক স্কুলের রক্তাক্ত অডিটোরিয়ামে। ছবি: রয়টার্স।

সংবাদ সংস্থা
পেশোয়ার শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:১৪
Share: Save:

তেরো বছরের ছেলেটার হাত ফুঁড়ে দিয়েছে দু’-দু’টো গুলি। মস্ত বড় হলঘরটা জুড়ে তখন রক্তের বন্যা। বন্ধুদের দেহের ছোট ছোট টুকরো ছুটছে এ-দিক ও-দিক। তারই কিছু ছিটকে আসছে ছেলেটার গায়ে, মুখে। গড়িয়ে পড়ছে বন্ধুদের রক্ত।

পেশোয়ারে সেনা স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র এহসান এলাহি। বুধবার তার কথা থেকেই অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে হামলার প্রকৃত ছবিটা। গত কাল মনে করা হয়েছিল, আত্মঘাতী জঙ্গিরা সোজা হানা দিয়েছিল ক্লাসরুমগুলোতেই। কিন্তু এহসান জানাচ্ছে, জঙ্গিরা প্রথম ঢোকে স্কুলের হলঘরে। সেখানে তখন সেনা প্রশিক্ষকদের কাছে ‘ফার্স্ট এড’-এর প্রাথমিক পাঠ নিচ্ছিল ছাত্ররা। বাইরে থেকে হঠাৎ একটা গুলির শব্দ কানে আসে তাদের। প্রশিক্ষকরা আশ্বস্ত করে বলেন, “কিছু হয়নি, শান্ত হয়ে বোসো।” তাঁরা কেউই তখন জানতেন না, স্কুলবাড়ির দরজার কাছে ইতিমধ্যেই প্রাণ গিয়েছে নিরাপত্তারক্ষীদের।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে গুলির আওয়াজ। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে হলঘরের দরজা-জানলার কাচ। একটু পরেই হলের দরজায় ভারী পায়ের লাথি। জঙ্গিরা হলে ঢুকে সটান স্টেজে উঠে পড়ে। এহসানের কথায়, “ওদের হাতের যন্ত্রগুলো থেকে ফোয়ারার মতো গুলি বেরোচ্ছিল। খুব কাছ থেকে মারছিল সবাইকে। দেখলাম, আমাদের শিক্ষকরা মাটিতে শুয়ে পড়ছেন। বন্ধুরা চিৎকার করছে, লুকোনোর জায়গা খুঁজছে। কিন্তু কয়েকটা বেঞ্চ বা চেয়ার ছাড়া আর কিছুই ছিল না ওখানে। ও রকমই একটা বেঞ্চের তলায় ঢুকে পড়ি আমি।”

একটানা গুলি চলে পরের দশ মিনিট। তত ক্ষণে আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই অত বড় ঘরটায়। শুধু অস্ফুট কিছু গোঙানির শব্দ। দশ মিনিট পর গুলিবৃষ্টি থামল। মিনিট খানেকের বিরতি। তার পর ফের। তবে এ বার আর এলোপাথাড়ি গুলি নয়, গোঙানির শব্দ লক্ষ্য করে করে বন্দুক চালাতে থাকে জঙ্গিরা। “আমি প্রাণপণে চুপ করে ছিলাম। এটুকু বুঝতে পারছিলাম, মুখ থেকে একটাও শব্দ বেরোনো মানে মৃত্যু,” বলে এহসান। মিনিট পনেরো পরে বাইরে থেকে গুলির শব্দ ভেসে এল। সেনাকর্মীরা এসে পাল্টা গুলি চালাচ্ছেন। সেই শব্দেই জঙ্গিরা হল ছেড়ে বেরিয়ে যায়। এহসান বলে, “তার পরেও আমি ভয়ে নড়তে পারিনি।” প্রায় দশ মিনিট পর সেনাকর্মীরা এসে উদ্ধার করার আগে পর্যন্ত বুলেট বেঁধা হাত নিয়ে বেঞ্চের নীচেই পড়ে ছিল সে। স্কুলের ওই হলঘর থেকেই পরে প্রায় একশো জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে।

বুকে আর পেটে গুলির আঘাত নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা বছর পনেরোর ইরফান উল্লা বলছিল তাদের শিক্ষিকা আফসা আহমেদের কথা। জঙ্গিরা ক্লাসে ঢুকতেই পড়ুয়াদের আড়াল করে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ২৪ বছরের তরুণী। বলেছিলেন, “আমায় না মেরে ছাত্রদের গায়ে হাত দিতে পারবে না তোমরা। আমার ছাত্ররা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে, এ আমি দেখতে পারব না।” এতটা সাহসের খেসারত অবশ্য দিতে হয়েছে আফসাকে। ছাত্রদের সামনেই তাঁর গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় জঙ্গিরা।

একই ভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছে স্কুলের অধ্যক্ষা তাহিরা কাজিকেও। মনে করা হচ্ছে, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল কাজি জাফরুল্লাকে বিয়ে করার ‘অপরাধেই’ তালিবানের নিশানায় ছিলেন তিনি।

জঙ্গিরা স্কুলে ঢোকার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন স্কুলেরই এক বাসচালক ইজাম উদ্দিন। জানালেন, সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ একটা গাড়ি করে এসেছিল জঙ্গিরা। সবাই সেনার পোশাকে। তাই প্রথমটায় সন্দেহ হয়নি। কিন্তু তার পরেই স্কুলের বাইরের একটি দেওয়ালে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় এক জঙ্গি। এর পর গাড়িটিকে স্কুলের পিছন দিকে নিয়ে গিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। স্কুলের মেন গেটের কাছে এসে এক জন সেনা, নিরাপত্তা রক্ষী ও মালিকে গুলি করে মারে। তার পরেই মই বেয়ে বড় কালো দেওয়াল পেরিয়ে স্কুলের ভিতরে ঢুকে পড়ে ওরা। আর তার পরেই টানা গুলির শব্দ। প্রতিটা ক্লাসরুমের মেঝেতে এখন পুরু হয়ে জমাট বেঁধে আছে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। দেওয়াল ভর্তি বুলেটের গর্ত। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে স্কুলব্যাগ, বইখাতা, ভাঙা চেয়ার।

আজ দিনভর নিহতদের শেষকৃত্য সেরেছেন পেশোয়ারবাসী। সেই সঙ্গে দেশ জুড়ে চলেছে শোকমিছিল, প্রতিবাদ, প্রার্থনা। মোমের আলো আর ফুলে ঢেকেছে আনাচ কানাচ। বন্ধ ছিল স্কুল-কলেজ-অফিস। সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, তিন দিন অর্ধনমিত থাকবে জাতীয় পতাকা। ১৪ বছরের ফাহাদের দেহ মাটি চাপা দিয়ে এলেন বাবা আখতার হুসেন। ছেলের পড়াশোনার দিকে তাকিয়ে বেশ কিছু দিন দুবাইয়ে শ্রমিকের কাজ করেছিলেন। বললেন, “যা কিছু করেছিলাম, কয়েক সেকেন্ডে শেষ করে দিল ওরা। আমার বেঁচে থাকার অর্থও শেষ হয়ে গেল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pakistan peshwar terrorist attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE