মাথার উপরে তখন গনগনে সূর্য। কিন্তু তীব্র গরম উপেক্ষা করেই এগিয়েছিল নাইজেরীয় কিশোর। কিছু দূর যেতে না যেতেই চোখে পড়ল গাছের গুঁড়ির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা প্রায় অচেতন দুই কিশোরী স্কুলছাত্রীকে। তাদের পোশাক ছিন্নভিন্ন, চোখমুখ থেকে রক্ত ঝরছে। জানা গেল, বোকো হারাম জঙ্গিরা তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। সে সব জেনেও ওই কিশোর অবশ্য ভাবলেশহীন। শৈশবে বোকো হারাম জঙ্গিদের যে তাণ্ডব সে দেখেছে, তার পর আর কোনও কিছুই তাকে আঘাত করে না।
কিশোরের নাম বাবা গনি। নাইজেরিয়ার চিবক, যেখান থেকে গত মাসে ২৭৬ জন স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করেছিল বোকো হারাম, তার কাছেই একটি গ্রামের বাসিন্দা বাবা। বা বলা ভাল প্রাক্তন বাসিন্দা। জঙ্গি হামলার ভয়ে এখন আর সেখানে থাকে না সে। তার মাথার দাম ১২ হাজার পাউন্ড বলে ঘোষণা করেছে বোকো হারাম। সে দিক থেকে দেখতে গেলে জঙ্গিদের ‘হিট লিস্ট’-এ প্রথম সারিতে রয়েছে ওই কিশোর।
কিন্তু তার ছেলেবেলাও তো গ্রামের আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মতো কেটেছিল। ভাইবোন, মা-বাবা সকলকে নিয়ে ছিল সুখী পরিবার। হয়তো দারিদ্র ছিল নিত্যসঙ্গী, পড়াশোনাও সে অর্থে বেশি দূর হয়নি, তবু জীবনটা তো সুন্দর ছিল। তার পর হঠাৎ এক দিন বদলে যায় সব কিছু। তীব্র হয়ে ওঠে বোকো হারামের অত্যাচার। শুধু অ-মুসলিমদের উপর নয়, মুসলিমদের মধ্যেও যাঁরা প্রশাসনের চর হিসেবে কাজ করতেন, তাঁদের খুঁজে বার করে খুন করতে শুরু করল জঙ্গিরা। বাবা তখন দশ বছরের। হঠাৎই এক রাতে তার বাড়িতে হানা দেয় জঙ্গিরা। চোখের সামনে খুন করে তার কাকাকে। তার বয়ানে, “তখনই আমার শৈশব শেষ হয়ে গিয়েছিল।”
তার পরে বাবাকে অপহরণ করে ‘সামবিসা জঙ্গল’-এ নিজেদের ডেরায় নিয়ে যায় জঙ্গিরা। সেখানে প্রতি দিন তাদের ফাইফরমাশ খাটতে হতো। তবে শুধু সে নয়, তার মতো এ রকম বহু ছেলেকেই অপরহণ করে নিয়ে আসত জঙ্গিরা। সকলকেই এ ভাবে খাটাত তারা। “আসলে আমরা সবাই ভয়ে থাকতাম। তাই যা বলত, তাই করতাম।” সে সময়ই বাবার নজরে এসেছিল কী রকম জীবন কাটায় জঙ্গিরা। খোলা আকাশের নীচে দিনের পর দিন কখনও অর্ধাহারে, কখনও অনাহারে কাটাতে হয়। সে অর্থে জীবনটা মোটেও সুখের নয়। কিন্তু তাতেই অভ্যস্ত এই নৃশংস মানুষগুলো। তবে যখন তাঁরা প্রার্থনায় বসেন, তখন বোঝার উপায় নেই তারা এতটা ভয়ানক। বাবার দাবি, “ওঁরা প্রথমে ভাল মানুষই ছিলেন। কিন্তু এখন আমি ওঁদের দাগি অপরাধী ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না।” খুব কাছ থেকে তাদের অপরাধের ছক কষা, অত্যাচার সব দেখেছিল ওই কিশোর। টানা দু’বছর ধরে। ফলে বোকো হারাম বললেই ঘৃণায় মুখ বিকৃত হয়ে যায় বাবার।
তার অবশ্য আরও একটা কারণ আছে। বাবার দাবি, এক দিন জঙ্গিদের নেতাস্থানীয় এক জন ‘আনুগত্যের পরীক্ষা’ দিতে জোরাজুরি করেন তাকে। নির্দেশ আসে, “তোর বাবাকে খুন করবি তুই নিজে।” সেটাই হবে আনুগত্যের পরীক্ষা। কী ভাবে পরিস্থিতি সামলাবে তা বুঝে উঠতে না পেরে জঙ্গি-সাথীদের সঙ্গেই গাড়িতে চড়ে বসে কিশোর। রীতিমতো সেজেগুজে। ভাবখানা এই যে সত্যিই যেন সে তার বাবাকে খুন করবে। গাড়ি যখন গ্রামের কাছে পৌঁছেছে, তখন এক রকম কৌশল করেই ওই পালিয়ে যায় বাবা। শুনতে পায় তার দিকে ধেয়ে আসছে গুলি। ভাগ্যক্রমে সে দিন প্রাণ বেঁচেছিল কিশোরের। কিন্তু সে দিন থেকেই সে প্রতিজ্ঞা করে, বোকো হারামের হাতে অত্যাচারিতদের সব রকম ভাবে সাহায্য করবে। যোগ দেয় উদ্ধারকারী দলে। সেই দলের সঙ্গেই গত মাসে জঙ্গল-অভিযানে এসেছিল বাবা। তখনই খোঁজ মেলে ধর্ষিতা দুই কিশোরীর। তড়িঘড়ি তাদের মুক্ত করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় বাবা।
তবে তা বলে সে নিজে এখন খুব নিরাপদে নেই। সে ও তার পরিবার এখন বোকো হারামের অন্যতম লক্ষ্য। পরিজনদের বাঁচাতে তাই আলাদা থাকে বাবা। কখনও সখনও দেখা করে বাবা-মার সঙ্গে। ব্যস ওটুকুই। জীবন কাটে আড়ালেই, জঙ্গলে লুকিয়ে, তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে।
তবে উদ্ধারকাজে সে এখন রীতিমতো দক্ষ। যেখান থেকে ওই দুই ছাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে বাবা জানতে পেরেছে, অপহৃতদের মধ্যে চারটি মেয়েকে ইতিমধ্যেই খুন করেছে জঙ্গিরা। কিন্তু আতঙ্ক এতটাই চেপে বসেছে গ্রামবাসীদের মধ্যে যে কেউই সরাসরি কিছু বলতে রাজি নয়। সবটাই আকারে-ইঙ্গিতে। ওই দুই কিশোরীর কথাও এ ভাবেই শুনেছিল বাবা।
তার পর গভীর জঙ্গলে গনগনে সূর্যের সঙ্গে লড়তে লড়তে এগিয়ে যাওয়া। সেখানেই নজরে আসে কিশোরীদের প্রায় অচেতন বন্দি দেহ দু’টি। ভাবলেশ হলেও ক্ষণিকের জন্য যেন শিউরে উঠেছিল বাবা।
দু’বছরের চেনা অত্যাচারের স্মৃতিগুলো থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই সেই বীভৎসতা মানতে পারেনি কিশোর-মন।