রাধারমণ মিত্রের ‘কলিকাতা-দর্পণ’ বইয়ে বলা হয়েছে, ডেভিড হেয়ার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীরা ঘোড়ার গাড়ির তুলনায় বেশি পছন্দ করতেন পালকিই। হেয়ার সাহেব কোনও দিন এক্কাগাড়ি বা ঘোড়ার গাড়ি চড়েননি। তাঁর বাহন ছিল পালকিই। পাশাপাশি, সম্ভ্রান্ত বাড়ির মেয়ে-বউরা পালকি করেই যেতেন গঙ্গাস্নানে। পালকিসমেত গঙ্গায় তাঁদের চুবিয়ে দেওয়া হত। তাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালেই সারতেন গঙ্গাস্নান।
কলকাতায় পালকি বেহারার কাজ করতেন দুলে ও বাগদি শ্রেণির মানুষ। কিন্তু পরে তাঁদের জায়গা নিয়ে নেয় অবাঙালি বেহারা। তাঁরা মূলত ছিলেন হিন্দুস্তানি এবং ওড়িয়া। কথিত, ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ‘রাজা’ উপাধি পাওয়ার পরে নবকৃষ্ণ দেব ওড়িশা ও হিন্দিবলয় থেকে বেহারাদের আনিয়েছিলেন। কারণ দুলে, বাগদি তাঁর কাছে ছিল ‘অস্পৃশ্য’। নথি বলছে, ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় একজন হিন্দুস্তানি পালকি বেহারার প্রতি মাসে বেতন ছিল ৪ টাকা। ওড়িয়া বেহারা পেতেন ৫ টাকা।
বেতের বোনা নিজস্ব পালকিতে থাকত গদি। আরোহীর পিঠের দিকে এবং দু’পাশে থাকত নরম তাকিয়া। ভাড়া পালকিতে গদি-তাকিয়া মোড়া থাকত খুব সরু কাঠির মাদুর অথবা শীতলপাটি দিয়ে। ব্যক্তিগত পালকিতে সে জায়গা নিত মরক্কো চামড়া। পালকির সাজ কেমন হবে, তার জন্যেও লাগত অনুমতি। ব্রিটিশ জমানা শুরুর আগে মুঘলদের অনুমতি সাপেক্ষে সমাজের বিশিষ্ট অভিজাতরা ব্যবহার করতেন রেশমের ঝালর লাগানো পালকি।
সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যেত পালকির সজ্জা। সেইসঙ্গে পালকির আগে পিছে চলা বাহিনীও। পালকির সওয়ার যত গণ্যমান্য, তত লম্বা হত সেই বাহিনীর যাত্রা। পালকির সামনে এবং পিছনে থাকতেন মশালচি, পেয়াদা, পাইক, বরকন্দাজ, হরকরার দল। বিশেষ বিশেষ জায়গায় বদলে যেত বেহারাও। ঠিক যেমন এখন দূরপাল্লার ট্রেনে নির্দিষ্ট স্টেশনে পরিবর্তিত হয় চালক।
শ্রীপান্থর ‘কলকাতা’ থেকে জানা যায়, সে সময়কার পালকি বেহারাদের নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন ইটালি থেকে আসা চিত্রশিল্পী বালসাজার। তাঁদের দক্ষতা সম্বন্ধে তিনি লিখেও গিয়েছেন। বলেছেন, আরোহীকে কিছুমাত্র টের পেতে না দিয়ে যে ভাবে তাঁরা কাঁধবদল করেন, তা বিস্ময়কর। শুধু অফিস-কাছারি, নতুন কনের শ্বশুরবাড়ি বা অভিজাত পরিবারের বধূর গঙ্গাস্নানই নয়। পালকিতে চেপে বাঙালি যেত তীর্থযাত্রাতেও।
তবে পালকিতে তীর্থযাত্রার জন্য পকেটে যথেষ্ট রেস্ত থাকতে হত। সে সব ছিল ধনীদের অভ্যাস। মধ্যবিত্তের কাছে তা ছিল আকাশকুসুম। তাই তাঁরা পালকি ভাড়া করতে পারতেন কাছেপিঠে কোথাও যাওয়ার জন্যই। অন্য দিকে ধনী বাঙালি বাবুরা একে অন্যের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বেহারা রাখতেন। দুই বেহারার পালকিতে মন ভরত না। মানও উঠত না। তাই নিদেনপক্ষে ৪ জন বা ছ’জন বেহারা না হলে বাঙালি বাবুশ্রেণির পছন্দ হত না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy