Follow us on

Download the latest Anandabazar app

© 2021 ABP Pvt. Ltd.

Advertisement

১৮ এপ্রিল ২০২৪ ই-পেপার

জীবনধারা

Hand pulled rickshaws: ঐতিহ্যবাহী হাতে টানা রিকশা আজও অলিতে-গলিতে কলকাতাবাসীর ভরসা

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:৩৬
কলকাতা শহর বিশ্বের দরবারে বিশিষ্ট তার বৈচিত্রময় ঐতিহ্যের জন্যই। শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে এই শহরের অবদান স্বীকার করেছে গোটা পৃথিবী। কলকাতার মানুষ পুরনোকে বর্জন না করে আপন করে নেন আশ্চর্য মমতায়। এই কথা কলকাতার হাতে টানা রিকশা সম্পর্কে বলাই চলে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, হাতে টানা রিকশা কলকাতার শহরের পথ-দৃশ্যের একটি বিশিষ্ট অংশ। এবং এই রিকশাওয়ালারা আজও কলকাতার সামাজিক কাঠামোর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

চা, ট্রাম, হাতে টানা রিকশা এবং গথিক স্থাপত্য হল সেই সব উত্তরাধিকার, যা ব্রিটিশরা রেখে গেছে বাংলায়। গঠনের দিক দিয়ে হাতে টানা রিকশাগুলি হালকা ওজনের, কাঠের রিকশাগুলি অপেক্ষাকৃত পাতলা।
Advertisement
'রিকশা' শব্দটি জাপানি শব্দ 'জিন-রিকি-শা' (জিন অর্থ মানুষ, রিকি অর্থ শক্তি এবং শা অর্থ যান- অর্থাৎ মানব-চালিত যান) থেকে উদ্ভূত হয়েছে। জাপানের এডো যুগে বাকি বিশ্বের থেকে জাপানের বিচ্ছিন্নতার অংশ হিসাবে, পশ্চিমী ধাঁচের চাকা দেওয়া যানবাহন চালানোর বিরুদ্ধে কিছু আইন মেনে চলা হত। এডোর পতনের সঙ্গে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হওয়ার পর জাপান রিকশা আবিষ্কার করে, ১৮৬৯ সালে। এর পর চিন, মঙ্গোলিয়া, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ হয়ে এখন ইউরোপের বহু দেশেও রিকশা পরিবহণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ক্যান্টন, সাংহাই এবং হংকং-এর মতো ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে নতুন অভিবাসীরা আসে এবং তারা কলকাতায় রিকশা চালু করে। অবশ্য হাতে-টানা রিকশা ইতিমধ্যেই কয়েক দশক আগে সিমলায় চালু করা হয়েছিল, যা ব্রিটিশ রাজের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসাবে কাজ করেছিল, যদিও সিমলায় এর ব্যবহার পাহাড়ি পথের কারণে সীমিত ছিল। ১৯১৯ সালে, ব্রিটিশরা হ্যাকনি ক্যারেজ অ্যাক্ট পাস করেছিল, যা কলকাতায় যাত্রী পরিবহণের মাধ্যম হিসাবে হাতে টানা রিকশা ভাড়া করার অনুমতি দেয়।
Advertisement
ইংরেজরা আসার আগে এ দেশে পালকির চল ছিল, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে যাতায়াতের প্রয়োজন বাড়ল আর ১৭৭৮ সাল থেকে শুরু হল পালকি রিলে পরিষেবা। ক্যাপ্টেন জন হার্বি কলকাতা থেকে বেনারসের মধ্যে এই পরিষেবার সূচনা করলেন। পালকির প্রয়োজন মূলত ছিল লম্বা রাস্তা পাড়ি দেওয়ার জন্য, খরচও হত ভালই। আর তাই ধনী বা শাসকশ্রেণির লোকেরাই মূলত পালকি চড়ার বাবুয়ানি দেখাতে পারতেন। কখনও অসুস্থ ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যও অবশ্য পালকির প্রয়োজন হত।

কলকাতা বিশেষজ্ঞ হরিপদ ভৌমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, ১৮৯০-এ চিন থেকে জাপানি রিকশার কাঠের সংস্করণটি ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় প্রথম আমদানি করেন এক ইহুদি ব্যবসায়ী। এর পর ১৯৩৩-এ ৬০০০ টানা রিকশাকে পাকাপাকিভাবে লাইসেন্স দেওয়া হয়। এর বেশি সংখ্যক রিকশা রাস্তায় দেখা গেলে তাদের বাতিল করা হবে এমন অলিখিত আইনও মানা হয়েছে বেশ অনেকটা সময়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ক্রমশ রিকশার সংখ্যা বেড়ে যেতেই থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, এশিয়ায় ঔপনিবেশিকতাবাদ হ্রাস পায় এবং হাতে-টানা রিকশা ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে ধীরে ধীরে ব্যবহার করা বন্ধ হয়ে যায়। চীনেও কমিউনিস্ট সরকার রিকশা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। অথচ কলকাতা শহরে কিন্তু রিকশার বিচরণ অব্যাহত একুশ শতকেও। হাতে টানা রিকশা মহানগরের একটি অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছে।

এই রিকশাগুলি শহরের পুরনো অংশের গলিতে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। বর্ষার সময় জল জমে ট্যাক্সি, গাড়ি এবং অটো চলাচলের অযোগ্য পথে এই রিকশাই ভরসা।

২০০৫ সালে, পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট সরকার টানা রিকশা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে, যার ফলে বিক্ষোভ ও ধর্মঘট হয়। ২০০৬ সালে, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছিলেন যে টানা রিকশা নিষিদ্ধ করা হবে এবং রিকশাচালকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আইন করে বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও উত্তর কলকাতায় বড়বাজার থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত হাতে টানা রিকশার আধিপত্য এতটুকুও কমেনি।

ব্রিটিশ প্রভুরা কলকাতায় যে হাতে টানা রিকশা চালু করেছিল তা এক সময় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্যগুলি-- বিহার এবং ওড়িশা থেকে আসা অভিবাসীদের জীবিকা অর্জনের মাধ্যম হয়ে ওঠে। আকাশচুম্বী ভবন এবং ফ্লাইওভারের আধুনিক কাঠামোর বিপরীতে হাতে টানা রিকশা কিন্তু আজও প্রমাণ দেয়, কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই। বিগত ১৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি কলকাতার রাস্তায় বহমান।

বর্তমানে, জনপ্রিয়তা হ্রাস এবং পরিবহণের অন্যান্য আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কারের কারণে, রিকশাচালকদের উপার্জন অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু বড়বাজার, কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া বা বৈঠকখানা বাজারের মতো জায়গায় হাতে টানা রিকশাই সওয়ারি ও পণ্য-- দুইয়ের পরিবহণ চালিয়ে যাচ্ছে।