Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Meher Afroz Shaon

‘রেললাইন থেকে তুলে আনা পাথরে ক্রস চিহ্ন এঁকে উপহার দিয়েছিলেন’

ঢাকা ক্লাবে হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে আড্ডায় অগ্নি রায়ঢাকা ক্লাবে হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে আড্ডায় অগ্নি রায়

মেহের আফরোজ শাওন।

মেহের আফরোজ শাওন।

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৭ ১৯:৩৫
Share: Save:

এই প্রজাপতি-সময়ে এমন একটি গভীর প্রশ্নের সামনে পড়ে, ধুকপুক বেড়ে যাবে— এ আর আশ্চর্য কী। আর প্রশ্নকর্তাটিও তো যে সে নন। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা লেখক, পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই হুমায়ুন আহমেদ।

প্রশ্নটি এবং প্রশ্নকর্তাকে আজও চোখের সামনে যেন ভাসতে দেখেন শাওন। ঢাকা ক্লাবের প্রশস্ত লনে এই প্রসঙ্গে তিনি কিছুটা স্মৃতিকাতরও। ‘‘উনি বলেছিলেন, গুহাচিত্র যাঁরা আঁকতেন, তাঁদেরও কাউকে লাগত ওই অন্ধকারে প্রদীপটা ধরে রাখার জন্য। যাতে সেই চিত্রকর নিজের কাজটা করতে পারেন। তুমি কি আমার জন্য সেই আলোটা ধরবে?’’

তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল কিশোরী মেহের আফরোজ শাওনের পৃথিবী। চুপ করে থেকেছিলেন কয়েকটা দিন। ‘‘কী বলব বলুন! ওই কথার মর্মোদ্ধার করার মতো বয়সও নয় সেটা। তারই চার-পাঁচ দিন পর উনি আবার বললেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যদি একা চলে যাই, সব ছেড়ে? তুমি থাকবে? আর কিন্তু উত্তর দিতে দেরি করিনি আমি। বলেছিলাম, থাকব। সবসময় থাকব।’’

কথা রেখেছিলেন শাওন। হিমু-র স্রষ্টা প্রবাদপ্রতিম এই মানুষটির হাত ছাড়েননি তাঁর মৃত্যু অবধি। তার অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের ঝড় উঠেছিল হুমায়ুনের দ্বিতীয় এবং অসমবয়সী বিবাহ নিয়ে। ছড়িয়েছিল অনেক রটনা, যা এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে শাওনকে। সম্প্রতি যার প্রতিবাদ করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন শাওন নিজেই। ইরফান খান এবং বাংলাদেশি অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা অভিনীত চলচ্চিত্র ‘ডুব’ ছবিটিকে ছাড়পত্র না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে সেন্সর বোর্ডে একটি চিঠি জমা দিয়েছেন তিনি। ‘ডুব’ নিয়ে শাওনের অভিযোগ, হ‌ুমায়ুন আহমেদের জীবনের কিছু স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সিনেমাটির চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছে, যার মাধ্যমে হ‌ুমায়ুন আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মানহানি ঘটতে পারে। যে চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন তার ভাষা অনেকটা এ রকম, ‘বেশ কিছুদিন আগে কলকাতা ও বাংলাদেশের কয়েকটি প্রভাবশালী গণমাধ্যমে ‘ডুব’ সিনেমার নায়কের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। যেখানে চরিত্র ও কাহিনি বিন্যাসে প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদের জীবনীকেই তুলে ধরা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু ছবিটির পরিচালক নিজে কখনও এই বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলেননি। আর আমার দুশ্চিন্তা মূলত এখানেই। আমি চাই না প্রয়াত স্বামী ও আমার জীবনের স্পর্শকাতর কোনও ঘটনা তুলে ধরা হোক যার কোনও ভিত্তি নেই। আর এ সব কারণেই ‘ডুব’ ছবি নিয়ে আমি আশঙ্কা প্রকাশ করেছি।’ বললেন, ‘‘আমি চাই না আমার সন্তান, পরবর্তী প্রজন্ম ভুল ধারণা নিয়ে বাঁচুক। হুমায়ুন আহমেদের মতো মাপের মানুষকে নিয়ে কোনও কাজ করতে হলে গবেষণা করা উচিত। আমি সেন্সর বোর্ডকে জানিয়েছি, যদি এই ছবি পরিমার্জন না করা হয়, আমি বাধা দিয়ে যাব।’’

আরও পড়ুন: দখলদারি সরিয়ে পাবনায় সুচিত্রার বাড়িতে দর্শনার্থীর ঢল

কী সেই স্পর্শকাতর ঘটনা?

এ বার আর স্মৃতিকাতরতা নেই। বরঞ্চ ঝাঁঝালো ক্ষোভ। ‘‘অনেক দিন ধরেই একটি গুজব সচেতন ভাবে ছড়ানো হয়েছে আমাদের লোকচক্ষে খাটো করার জন্য। এই ছবিটিও সে ভাবেই সাজানো হয়েছে। দেখানো হয়েছে, হুমায়ুন আহমেদের মেয়ের এক বান্ধবী তাঁদের বাড়ি আসত। সেখান থেকেই নাকি প্রেম। কি ডাহা মিথ্যা কথা এটা।’’ শাওন জানাচ্ছেন, কস্মিনকালেও হুমায়ুনের কন্যার সঙ্গে বন্ধুত্ব দূরস্থান, কোনও পরিচিতিও ছিল না। ‘‘থাকবেই বা কী করে! আমাদের স্কুল-কলেজ সবই তো আলাদা। পরিচয়ের সূত্রটা তো ছিল গান।’’

রবীন্দ্রসঙ্গীতের অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন হুমায়ুন। দিনভর প্রবল পরিশ্রমের মধ্যে সেটাই ছিল তাঁর বড় আশ্রয়ের জায়গা। সেখানেই গান দিয়ে দ্বার খুলেছিলেন শাওন। বা বলা ভাল, তিনি খোলেননি, দরজা খুলে গিয়েছিল আপনা হতেই। শাওন বলছেন, ‘‘সেই ক্লাস সিক্স-এ পড়ার সময় থেকেই তো ওনার নাটকে অভিনয়, গান করি। ইউনিটের কেউ যদি গান জানতেন, উনি রিহার্সালের পর তাঁর কাছে শুনতে চাইতেন। সেই ভাবে আমার কাছেও অনেক বার শুনতে চেয়েছেন। আমি খুব চটপট গান তুলে নিতে পারতাম বলে আমার নাম দিয়েছিলেন টেপ রেকর্ডার!’’ সেই ‘টেপ রেকর্ডার’ যে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কবে থেকে বাজতে শুরু করল হুমায়ুনের জীবনে, আজ আর তার সঠিক ঠাহর পান না শাওন। ‘‘মাঝে মাঝে সিগারেটের রাংতায় হাতচিঠি দিতেন। একবার লিখে দিয়েছিলেন সুনীলের লাইন— ‘ভ্রু পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে।’ হয়তো রিহার্সালের পর একা বসে খাচ্ছেন, আমি হয়তো এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি কিছু লাগবে কি না। ছেলেমানুষের মতো খুশি হতেন। একটু যত্ন একটু মায়া খুবই চাইতেন উনি।’’

সেই মায়ার কি অভাব ঘটেছিল একটা সময়ে পৌঁছে? অজস্র অমর চরিত্রের এই স্রষ্টা কি মধ্যজীবন পার করে নিজেই হয়ে উঠছিলেন নিঃসঙ্গ কোনও চরিত্র ?

জবাবে কোনও নেতিবাচক উত্তর কিন্তু পাওয়া গেল না শাওনের কাছে। হুমায়ুনের প্রথম স্ত্রী গুলকেতিন সম্পর্কেও উষ্মার প্রকাশ ঘটালেন না। শুধু এটুকুই বললেন, ‘‘দেখুন সবাই শিক্ষিত মানুষ। কখনও কোনও কটু বাক্য বিনিময় হয়নি আমাদের মধ্যে। বরং হুমায়ুন সাহেবের বড় পুত্র নুহাসের সঙ্গে আমার মধুর স্মৃতি রয়েছে। আমরা ওকে নিয়ে বিদেশে বেড়াতেও গিয়েছি। এখন আর কোনও যোগাযোগ নেই। কিন্তু আমি অপেক্ষা করব। আমার ধারণা, ও যখন সত্যি বড় হয়ে যাবে সে দিন আমাদের আবার দেখা হবে।’’

পরিবেশ এবং রাত দু’টোই ভারী হয়ে আসছে। একটু হালকা করতে, প্রশ্নটা করেই ফেললাম। হুমায়ুন আহমেদের কাছ থেকে পাওয়া প্রিয়তম উপহারটা কী? ‘‘বিয়ের আগে আমি তো কোনও দামি উপহার নিতাম না। ওনার পাথরপ্রীতি ছিল খুব। একটা লাল গোমেদ দিয়েছিলেন, খুবই দামী। আমি নিইনি। তারপর যেটা দিলেন তা ওনার পক্ষেই সম্ভব। রেললাইন থেকে তুলে আনা একটা বড় পাথরে কলম দিয়ে কয়েকটা ক্রস চিহ্ন করে দিয়ে বলেছিলেন, এটা নিতে নিশ্চয়ই কোনও বাধা নেই! আমি সেই পাথরটার প্রেমে পড়লাম যেন। সব সময় সঙ্গে রেখে দিতাম, কলেজে নিয়ে যেতাম! মা তিতিবিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন আমার আচরণে। ওনার একটা গল্প রয়েছে পাথর নামে। সেই গল্পে এই ঘটনার ছায়া রয়েছে।’’

সেই পাথর কি এখনও রাখা রয়েছে শাওনের কাছে? না, এই প্রশ্নটা করে ওঁর স্মৃতির উপর আর চাপ তৈরি করতে চাইনি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE