অন্য শৈশব: কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা শিশুরা। নিজস্ব চিত্র
বছরখানেক আগেও ছিল গভীর জঙ্গল। হাতি এবং অন্য জন্তুদের নিভৃত খেলাধুলোর জায়গা। এখন কক্সবাজার-টেকনাফ হাইওয়ে থেকে ডান দিকে পাহাড়ি চড়াই-উতরাই বরাবর সেই জঙ্গল প্রায় নিশ্চিহ্ন। ৬ হাজার একর জুড়ে শুধু প্লাস্টিক শিট, খুঁটি আর লক্ষ লক্ষ মানুষের অরণ্য। তারই মধ্যে সরু গলি, সেখানে সারি দিয়ে শাকসব্জির দোকান। মণিহারি দোকানের মিনিয়েচার সংস্করণ। ফুল দিয়ে সাজানো বিয়ের গাড়িও রয়েছে!
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের গ্রাউন্ড জিরো। কক্সবাজার জেলার এই কুতুপালন শিবিরে রয়েছেন মায়ানমার থেকে তাড়া খেয়ে আসা প্রায় ৮ লাখ মানুষ। সাংবাদিকদের কনভয় দেখে চারপাশে কৌতূহলী চোখের মেলা। বাংলাদেশ সরকার যতটা সম্ভব চেষ্টা করছে এই শিবিরটি চালু রাখার। ৩০টি ক্যাম্প এবং ১২টি খাদ্য সরবরাহ কেন্দ্রে ভাগ করে তৈরি হয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ইউনিসেফ অসংখ্য তাঁবু খাটিয়ে চালাচ্ছে ঢালাও সরবরাহ। খোঁড়া হয়েছে সাড়ে আট হাজার গভীর নলকূপ। পাঁচটি নতুন পুলিশ থানাই তৈরি হয়েছে এখানকার নিরাপত্তার জন্য।
এক কথায় আপাতত নিরাপদেই থাকার কথা শরণার্থীদের। অন্তত এই মুহূর্তে প্রাণের আশঙ্কা নেই, প্রতি পরিবারে মাসে ৩০ কেজি চালের সরবরাহ রয়েছে। অনেকে পুর্নবাসনের কাজে হাত লাগিয়ে এনজিও-র টাকাও পাচ্ছেন। তা-ও পরিবার হারানো মহম্মদ শফি, চোখের সামনে স্বামীকে মরতে দেখা জমিলা বেগমদের প্রশ্ন করে একটাই উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। ‘‘এখানে আর কত দিন থাকব? যদি ন্যাশনাল কার্ড পাই, নিরাপত্তার গ্যারান্টি পাই, ফিরে যেতে চাই।’’ কিন্তু যে পরিস্থিতিতে চলে এসেছিলেন, সে কথা মনে করলে এখনও কেঁপে উঠছেন ভয়ে।
মায়ানমারের মংদুপুরা থেকে একবস্ত্রে চলে এসেছিলেন জমিলা আজিজ। আপাদমস্তক বোরখাও আটকে রাখতে পারছে না কান্না। ‘‘বড় বাচ্চাটা ইস্কুলে পড়ত। ওর
বাপের সঙ্গে ওকেও শেষ করে দিল। পরিবারের বাকি যে ক’জন বেঁচেছিল তাদের নিয়ে ১৫ দিন লাগাতার পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে চলে এসেছিলাম।’’ জাহিদ হুসেন বলছিলেন, ‘‘রাখাইনে আমাদের মহল্লার চারপাশটা ধীরে ধীরে সেনারা ঘিরে নিল। প্রথমে বলত, তোমরা বাঙালি। এ দেশ থেকে চলে যাও। চব্বিশ ঘণ্টা টহল দিত। তারপর হঠাৎই শুরু হল আক্রমণ।’’ বর্মি কায়দায় লুঙ্গি আর বাংলাদেশি ফতুয়া পরিহিত মৌলবী মাসুদ বলছেন, ‘‘সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে দেখি, আমার বৌকে নির্যাতন করে মেরে দাওয়ায় ফেলে রেখে গিয়েছে মায়ানমারের সেনা। বাচ্চাদের বুকে আগলে পরের রাতেই পালিয়ে চলে আসি।’’
সেই ‘আসার’ দৃশ্য মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার মহম্মদ নিকারুজ্জামানও। গত বছর ৬ সেপ্টেম্বর। ‘‘সন্ধ্যা থেকে অঝোরে বৃষ্টি। টেকনাফ হাইওয়ে ধরে যেতে যেতে হঠাৎই অন্ধকারে চোখে পড়ল অগণিত মানুষের ঢল। ভুতুড়ে ছবির মতো নিশ্চুপে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাইওয়ের ধারে। ওই দৃশ্য জিন্দেগিতেও ভুলব না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy