Advertisement
০৩ মে ২০২৪
শত্রু ঘরের না বাইরের

জঙ্গিরা বাড়ছে আড়ে-বহরে, উদ্বিগ্ন ডোভাল

বাংলাদেশের গুলশনে শুক্রবারের জঙ্গি আক্রমণের পিছনে আইএস কতটা সক্রিয় ভূমিকায় ছিল, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের কাছে অনেক বেশি উদ্বেগের হল, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ জুড়ে আইএস-এর বাড়বাড়ন্ত।

মোমের আলোয়। হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হানায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধায় মিছিল, ঢাকায় রবিবার। ছবি: রয়টার্স

মোমের আলোয়। হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হানায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধায় মিছিল, ঢাকায় রবিবার। ছবি: রয়টার্স

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩০
Share: Save:

বাংলাদেশের গুলশনে শুক্রবারের জঙ্গি আক্রমণের পিছনে আইএস কতটা সক্রিয় ভূমিকায় ছিল, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের কাছে অনেক বেশি উদ্বেগের হল, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ জুড়ে আইএস-এর বাড়বাড়ন্ত। যা ভবিষ্যতে আরও বড় আতঙ্কের কারণ হতে পারে। অজিত ডোভাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং গোয়েন্দাদের কাছে এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারকেও এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।

এত দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, আইএস-কে তাঁরা কখনওই বরদাস্ত করেননি, দেশে জঙ্গিদের দাঁত ফোটাতে দেননি। কিন্তু গুলশনের ঘটনা সেই অহঙ্কারে আঘাত করেছে। এই ঘটনায় এক দিকে যেমন গোয়েন্দা ব্যর্থতা রয়েছে, তেমনই এটাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, আইএস মদত পুষ্ট জঙ্গিরা এই মুহূর্তে ঢাকায় রীতিমত তৎপর। বস্তুত, ২০০৩-এ জন্মের পর থেকেই আইএস-এর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার। ওয়াশিংটনের ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স কলেজ’ একবার জানিয়েছিল, বাংলাদেশের ইতিহাসে ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীর একটা ঐতিহ্য রয়েছে, ফলে সে দেশকে জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে পূর্ব ভারত তথা গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলা আইএস-এর লক্ষ্য। দশ বছর আগে খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনই মার্কিন গোয়েন্দারা বাংলাদেশকে সতর্ক করে বলেছিলেন, সে দেশের স্থানীয় কিছু যুবককে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ইরাকের কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী। মার্কিন ও ভারতীয় গোয়েন্দারা মনে করছেন, খালেদা সরকার সেই সব সতর্কতাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও মার্কিন গোয়েন্দারা আইএস-এর কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। বাংলাদেশ পুলিশ সে সময় আইএস সাহায্যপুষ্ট কিছু জঙ্গিকে গ্রেফতারও করে। তখনও মার্কিন গোয়েন্দারা বলেছিলেন, ইসলামি রাষ্ট্রবাদকে সামনে রেখে আইএস বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। কিন্তু তাঁদের ধারণা, হাসিনা সরকারও আইএস-এর বিপদকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। সে কারণেই ওই সময় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের আসল নেতা কারা ছিল, তাদের কার্যকলাপের কাঠামো কী ছিল, সেগুলো নিয়ে যথেষ্ট তদন্ত হয়নি। গোয়েন্দাদের অনেকেরই মত, হাসিনা সরকার মনে করে এসেছে যে, আইএস-এর সক্রিয় ভূমিকাকে গুরুত্ব দিলে সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে যাবে। ফলে তারা স্থানীয় জঙ্গিদের ভূমিকাকেই তুলে ধরতে চাইছে।

অজিত ডোভাল সম্প্রতি মার্কিন এফবিআই-এর কর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে এক দফা আলোচনা সেরেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদ মনে করছে, বাংলাদেশে আইএস-এর আপাত রণকৌশল হল, এক) গোটা দেশ জুড়ে খুব বেশি প্রচার না চালানো; দুই) বিভিন্ন পুলিশ চেকপয়েন্ট কিছু বিক্ষিপ্ত আক্রমণ; তিন) বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করা— গুলশনের ঘটনাতেই ৯ জন ইতালীয় ও ৭ জন জাপানি নাগরিককে হত্যা করেছে জঙ্গিরা; এবং চার) বিভিন্ন ধর্মস্থানে ও যানবাহনে আক্রমণ চালানো। ২০১৫ সালের পরে এই ধরনের হামলা ক্রমশ বাড়ছে বাংলাদেশে।

অজিত ডোভালের তদন্ত টিম মনে করছে, এই কৌশলে শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্থানীয় জঙ্গিদের টাকা ও সাহায্য দিয়ে আড়েবহরে বাড়ছে আইএস। সেই সঙ্গেই কৌশল বদলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর হামলার সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। হামলা বেড়েছে অ-ভারতীয় বিদেশিদের উপরেও। বিশেষ করে জাপানি ও ইতালীয়দের উপর। এই আক্রমণে ভারত নানা কারণে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশকে ভারতের মিত্ররাষ্ট্র বলে মনে করা হয়। চিন-পাকিস্তান অক্ষকে কূটনৈতিক মহল যেমন একই বন্ধনীতে রাখে, ঠিক সেই ভাবে ভারত-বাংলাদেশকে আর একটি অক্ষ ধরা হয়। ফলে ইতালি বা জাপানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আঘাত করাটা জঙ্গিদের একটা লক্ষ্য। আবার জাপানের মতো রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত, বাংলাদেশের সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারলে চিন-পাকিস্তান অক্ষ শক্তিশালী হয়। এই তথ্যগুলিকে মাথায় রেখে যৌথ তদন্ত চালানো হচ্ছে।

ভারত মনে করে, আইএস কার্যকলাপ মোকাবিলায় হাসিনার আন্তরিকতার কোনও অভাব নেই। গত দু’বছরে বাংলাদেশে যে ভাবে জঙ্গি কার্যকলাপ বেড়েছে, ২০১৬-য় সেটা নিয়ে প্রকাশ্য রাজনীতি যা-ই হোক না কেন, ভিতরে ভিতরে যথেষ্ট কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর বাংলাদেশ। স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীরা যে গুলশনের ঘটনায় জড়িত করেছে, তা-ও অসত্য নয়। তাই ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপও বাংলাদেশের সঙ্গে সুরে সুর মিলিয়ে আইএস-র ভূমিকাকে প্রকাশ্যে গুরুত্ব না দিয়ে স্থানীয় জঙ্গিদেরই দায়ী করেছেন। তবে ডোভাল কিন্তু মনে করছেন, এই ঘটনাগুলির মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। গুলশনের পিছনে আইএস-মস্তিষ্কের ছাপ স্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে আইএস যাতে কোনও ভাবেই হাসিনা সরকারকে দুর্বল করতে না পারে, সে জন্য ভারত সব রকম চেষ্টা করছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ajit Doval Terrorism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE