আবৃত্তির ক্লাসরুমে আমরা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছি। টেকনিক্যাল স্কিল শেখা হয়েছে। থিওরিও শেখা হয়েছে কিছু। কিছু না-জানাও রয়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত যেটুকু জেনেছি, সেটুকু নিয়ে আজ মঞ্চ উপস্থাপনার কথা ভাবা যাক।
আবৃত্তি মূলত শ্রুতিশিল্প। কিন্তু যখন আমি কবিতাকে, আবৃত্তিকে মঞ্চে উপস্থাপনা করার কথা বললাম তখন কিন্তু আবৃত্তি আর শ্রুতিশিল্প থাকল না। আবৃত্তি শ্রাব্য থেকে দৃশ্যও হয়ে উঠল। সেটাই স্বাভাবিক। মঞ্চে যখন এসে দাঁড়াচ্ছেন একজন আবৃত্তিকার, তখন শ্রোতারা তো শুধু তাঁর কথা শুনছেন না, তাঁকে দেখছেনও। ফলে আবৃত্তি তখন শুধু কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ, ছন্দ, অভিব্যক্তি নিয়েই হাজির হচ্ছে না, আবৃত্তি প্রাণ পাচ্ছে শিল্পীর দাঁড়ানোয়, তাঁর ব্যক্তিত্বে, মঞ্চের সাজে। সব মিলিয়ে কবিতা আর কণ্ঠকে কেন্দ্রে রেখে আবৃত্তি তখন এক কম্পোজিট শিল্প। তাই মঞ্চে আবৃত্তি করার সময় কবিতা নিয়ে যেমন ভাবতে হয়, তেমনই ভাবতে হয় অন্য বিষয়েও— পোশাক নির্বাচন, মঞ্চে নিজের উপস্থিতি ও নিজস্ব স্টাইলে দর্শককে ধরে রাখা।
আমার মনে পড়ে নব্বইয়ের দশকে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের একক অনুষ্ঠান। মঞ্চে শিল্পী একা, এ পাশে ও পাশে রাখা নানা বাদ্যযন্ত্র। শিল্পী নিজেই চলে যাচ্ছেন এই বাজনা থেকে ওই বাজনায়, শ্রোতাদের সঙ্গে, দর্শকদের সঙ্গে কথা বলছেন, গানে কথায় নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নিচ্ছেন শ্রোতাদের—তাঁর নিজস্ব ধরনে, নিজস্ব ভঙ্গিতে। মনে হল, এটা শুধুই গানের অনুষ্ঠান নয়—তার থেকে বেশি কিছু।
এই ‘বেশি কিছু’ দিতে পারাটাই একজন শিল্পীর সাফল্য। এর জন্য যেটা দরকার সেটা হল, মঞ্চে ওঠার আগে অনুষ্ঠানটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা। আমি যেখানে আবৃত্তি করব, সেটি কি কোনও বড় প্রেক্ষাগৃহ? নাকি ছোট সভাঘর? নাকি ঘরোয়া কোনও আসর? সেখানে যাঁরা আসবেন, তাঁরা কি দীক্ষিত শ্রোতা? তাঁরা কি নিয়মিত কবিতা পড়েন? নাকি মাঝে মাঝে পড়েন? তাঁরা সবাই কি কবিতা পড়েন, নাকি কেউ কেউ পড়েন? এগুলো ভাবব, কেননা এগুলোর উপর নির্ভর করবে আমার কবিতার নির্বাচন। আমার সাজপোশাক এবং আমার উপস্থাপনার ধরন।
সবচেয়ে আগে দরকার কবিতার নির্বাচনে যত্ন নেওয়া। অনেক সময় দেখি সাম্প্রতিক কোনও ঘটনার সঙ্গে কবিতাটিকে যুক্ত করতে পারলে শ্রোতারা সহজে কবিতাটির কাছে পৌঁছতে পারেন। কোন কবিতা বলব, সেটা ভাবার জন্য প্রচুর কবিতা পড়তে হয়। প্রচলিত, খুব বেশি প্রচলিত নয়—সব কবিতা। অনেক সময়ই দেখি, খুব দুঃখের সঙ্গেই দেখি, যাঁরা আবৃত্তি করেন তাঁরা শুধু জনপ্রিয় কিছু কবিতার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন। নতুন শিল্পীদের জন্য এটা বেশ বড় ভুল। জনপ্রিয় কবিতা, বিশেষত যে কবিতা অন্য শিল্পীর কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়েছে, সে সব কবিতা না বলাই ভাল। নতুন শিল্পীর কণ্ঠে সেগুলো বেশি গৃহীত না হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। আমিও ‘অন্য শিল্পীর কণ্ঠে জনপ্রিয়’ কবিতা বেশি বলি না। ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ গৌরীদির (গৌরী ঘোষ) কণ্ঠে এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে সেটা আমি এড়িয়ে চলারই চেষ্টা করি।
কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি কোথায় বলছি, আর কারা শুনছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। দীক্ষিত শ্রোতার সামনে আমি একটু বেশি সিরিয়াস কবিতা বলতে পারি। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে আমাকে একটু সর্বজনগ্রাহ্যতার কথা ভাবতে হবে। তবে, আবারও বলি, সর্বজনগ্রাহ্য কবিতা মানেই বহুল প্রচলিত কবিতা নয়। অপ্রচলিত কবিতার মধ্যেও সর্বজনগ্রাহ্য কবিতা আছে। সেগুলো নিজেকে বার করতে হবে।
যে কবিতাই বলি, যেখানেই বলি, নিজের কাজকে ভাল লাগানোর প্রথম কথা শ্রোতাকে ছুঁয়ে যাওয়া। মঞ্চে ঢোকা, দাঁড়ানো, আবৃত্তি, বেরিয়ে যাওয়া—সমস্তটাই শ্রোতাকে নিয়ে পথ চলার পর্ব। এই পথ চলায় শ্রোতাকে কাছে পাওয়া যায় যখন শিল্পের সঙ্গে শিল্পী একাত্ম হয়ে যান। এই একাত্মতা যেন উপস্থাপনার সময় বেরিয়ে আসে সমস্ত শরীরে। শ্রোতা যেন বুঝতে পারেন তাদের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীও উপভোগ করছেন অনুষ্ঠানটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় স্তরে একটি আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিযোগিতাটির শিরোনাম ‘পোয়েট্রি আউট লাউড’। ওয়েবসাইটে প্রতিযোগিতার ভাল পারফর্মারদের ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপিং আছে। ভিডিওগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন প্রত্যেক প্রতিযোগী বা শিল্পী কী ভাবে একাত্ম হয়ে গেছেন কবিতার সঙ্গে। সবচেয়ে লক্ষণীয় শিল্পীদের শারীরিক উপস্থিতি। যদি শব্দ ছাড়াও ভিডিওগুলো দেখেন, দেখবেন কী ভাবে অভিব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মুখের পেশির চলন, হাতের অবস্থান, কী ভাবে শব্দ ছাড়াই বাঙ্ময় হয়ে উঠছেন তাঁরা। ভাষাকে অতিক্রম করে কবিতার নিজস্ব ভাষায় ছন্দোময় হয়ে উঠছে তাঁদের উপস্থাপনা।
নিজেকে তুলে ধরা, নিজেকে ক্যারি করার কাজটা নিজেকেই ভাবতে হয়। নিজের স্টেটমেন্ট, নিজের পোশাক—এগুলো নিজেকেই ভাবতে হয়। কিছু দিন আগে ই মেলে একজন পাঠক প্রশ্ন করেছিলেন, আবৃত্তি করার সময় পুরুষদের কি পাঞ্জাবি পরতেই হবে? উত্তরে বলি, আমি ব্যক্তিগত ভাবে পাঞ্জাবিটাই পছন্দ করি। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন, জিনস–টিশার্ট বা অন্য কোনও পোশাকে তিনি কবিতাকে পৌঁছে দিতে পারবেন, তিনি সেটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সুমন চট্টোপাধ্যায় এ ধরনের পোশাক পরেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন এবং দর্শকদের কাছে পৌঁছতেও পেরেছেন। প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে প্রথাবিরুদ্ধতাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেটা কেউ চাইলে করতে পারেন।
মঞ্চে কবিতা বলার সময় কবিতাকে কেন্দ্রে রেখে চারপাশটা নিয়েও একটু ভাবতে হয়। আবার এটাও দেখতে হবে সেই চারপাশ সাজানোটা— যন্ত্রসঙ্গীতে, আবহে, আলোতে, যেন এমন না হয় যে কবিতাটা গৌণ হয়ে গেল। কিছু দিন আগে সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় আমরা ‘শেষের কবিতা’ করেছিলাম। যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের মনে থাকতে পারে, সেই প্রযোজনার মঞ্চবিন্যাস, পোশাক পরিকল্পনা আর ভিডিও-র ব্যবহারের কথা। শ্রুতিনাটকে সাধারণত দৃশ্য চিহ্নিত হয় আবহ দিয়ে। এখানে সুমন ব্যবহার করেছিলেন ভিডিও ক্লিপিং। শিলঙের পটভূমিতে তোলা সেই দৃশ্যচিত্র মূল প্রযোজনাকে কোথাও ধাক্কা না দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল সুন্দর ভাবে। অমিত আর লাবণ্যের পরিচয়ের মুহূর্তটি যে ভাবে দেখানো হয়েছিল ট্রলি ব্যবহার করে, তাতে ব্রডওয়ে প্রযোজনার কথা মনে হয়। সবচেয়ে লক্ষণীয় হল, এত কিছুর পরেও সুমনের নাটকটিতে শ্রুতিমাধ্যমই কেন্দ্রে ছিল।
গানের অনুষ্ঠানেও দেখি, শিল্পীরা কিন্তু শুধুই গান করেন না। তাঁরা পোশাক, সেট, লাইট—এ সবই ব্যবহার করেন। সে মাইকেল জ্যাকসনই হোন বা আমাদের টেলিভিশনের কোনও গানের অনুষ্ঠান—সব জায়গাতেই গানকে কেন্দ্রে রেখে দৃশ্যমাধ্যম নিয়েও ভাবনাচিন্তা করা হয়। কবিতাতেও ভাবা যায় এ রকম। অবশ্যই কবিতার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি লেখা থেকে তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। কবি গিয়েছিলেন ফ্রান্সের একটি কবিতা উৎসবে যোগ দিতে। সেখানে তাঁর সঙ্গে আরও ন’জন ভারতীয় কবির কবিতা পাঠ করা হবে। মূল কবিতা, সঙ্গে অনুবাদ। নীরেন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদ করেছিলেন এক অধ্যাপক। তিনি কবির কাছে জানতে চান কবির কোন কবিতা ছেলেদের আর কোন কবিতা মেয়েদের গলায়। এটা বললে ভাল হয়। কবি জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘কেন, অনুবাদ আপনি পড়বেন না?’’ উত্তরে অধ্যাপক বলেন, ‘‘না, আবৃত্তি তো একটি শিল্প। তাই কিছু ছেলেমেয়েকে নির্বাচন করা হয়েছে, যারা এটায় পারদর্শী।’’ সেই উৎসবে কবিতা পড়া হয়েছিল আলোকসম্পাত আর মঞ্চবিন্যাস ব্যবহার করে। উদ্যোগটির এবং উপস্থাপনাটির প্রশংসা করেছিলেন কবি।
সব শেষে বলি, নিজের মতো করে, নিজের স্বাক্ষর রেখে একটা সুসমঞ্জস, নিটোল উপস্থাপনার কথা আপনাকেই ভাবতে হবে। সেখানেই আপনার মৌলিকতা। সেখানেই আপনি ‘আপনি’ হয়ে উঠবেন।
আবৃত্তির ক্লাস নিয়ে কোনও প্রশ্ন আছে আপনার? সরাসরি জেনে নিন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। bratatiblog@gmail.com-এ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy