বিতর্ক শেষ। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে। কী হবে এই চিন্তায় বিশ্বজুড়ে বাজার সংশয়ে কাতর। শেয়ার সূচক নড়বড়ে। সংশয় শুধু অর্থনীতিতে নয়, সংশয় আগামী দিনে বিশ্বের চরিত্রটা কী দাঁড়াবে তাই নিয়ে।
ইউরো জোট দানা বাঁধার শুরু থেকে বিভিন্ন বিতর্কে জর্জরিত ছিল। তবে একাধিক সার্বভৌম দেশকে এক বাজার, এক মুদ্রা, এক কথায় জোটের মধ্যে মুক্ত বাজার তৈরি করার একটা বড় সমস্যা ছিল স্বাধিকার এবং সার্বভৌমত্বকে দাঁড়িপাল্লায় রেখে এগনো। আর ব্রিটেনের এই বেরিয়ে যাওয়াকে নাগরিকের মনে স্বাধিকার এবং সার্বভৌমত্ব এক করে ফেলার সমস্যা থেকে যতটা না অর্থনীতি তার থেকেও অনেক বেশি একদেশদর্শী নাগরিকদের চাপেই এই ব্রেক্সিট। এর পিছনে অবশ্য গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক অবস্থা অনেকটা দায়ী। অনেকেই মনে করছেন, যে সমস্ত নেতা ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিতে নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করেছেন তারা এই সার্বভৌমত্বকে সম্পূর্ণ অন্য জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করে নাগরিকদের মনে স্বাধিকার আর সার্বভৌমত্বের মধ্যে বিভেদটা এক করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্বের রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে গোটা ইউরোপ খানিকটা ‘বিদেশি হঠাও দেশ বাঁচাও’ এই পরিচিত রাজনৈতিক স্লোগানের উপর ভিত্তি করে বাকি যুক্তিগুলো সব সাজিয়েছিল। ২০১৫-য় প্রায় ৩৩ লক্ষ বিদেশি ইংল্যান্ডে ঢুকেছে। আর সমস্যার আসল সূত্রপাত বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্রিটেন ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে স্কটল্যান্ড আবার ব্রিটেন থেকে নিজেকে বের করে নেওয়ার জন্য গণভোটের দাবি তুলেছে। স্কটল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকতে চায়। স্কটল্যান্ড যদি ইংল্যান্ড থেকে বেরিয়ে যায়, তা হলে বিশ্ববাজারে ব্রিটেনের কতটা জোর থাকবে তাই নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্নচিহ্ন উঠে গিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া এক দিনেই শেষ হবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বছর দুয়েকের বেশি লাগবে বিভিন্ন স্তরের আর্থিক চুক্তিগুলোকে নতুন ব্যবস্থায় নতুন করে ঢেলে সাজতে। কিন্তু জার্মানি ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরনো মানে ইইউ-এর বাইরে থাকা। জার্মানির অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “ইন ইজ ইন, আউট ইজ আউট।” একটা বড় সংখ্যক বিশেষজ্ঞের অভিমত যে, পাউন্ডকে অক্ষুণ্ণ রেখে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাজারে সংযুক্ত থাকার ব্যবস্থা করাই যেতে পারে। কিন্তু সেটা কতটা সম্ভব তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে যে চিত্রটা বেরিয়ে আসবে, তা হল ব্রেক্সিট ইউরো বিরোধীদের নতুন অক্সিজেন জোগাল। গ্রিসের পর সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ইউরো বিরোধিতা বেশি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ফ্রান্সে।
অর্থনীতির সঙ্গে সাধারণ জীবন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। ইতালির মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনে নাকি প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারের এক জন ব্রিটেনে পড়াশোনা করেন। আগামী অভিবাসন নীতিতে যে ভয়টা তৈরি হয়েছে তা হল, আগামী দিনে ব্রিটেনে থাকার ব্যাপারে নতুন অভিবাসন নীতি। অর্থনীতিবিদরা প্রায় একজোটেই জানিয়েছেন যে, ব্রেক্সিটের পরে ব্রিটেনের অর্থনীতি নিশ্চিত ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাউন্ড, যে মুদ্রা নিয়ে ব্রিটিশদের এত গর্ব তা যদি পড়তে থাকে তা হলে আমদানির খরচ বাড়বে। ব্রেক্সিট-এর পক্ষে যাঁরা মত দিয়েছিলেন তাঁদের বক্তব্য, পাউন্ডের দাম কমলে খারাপ কী, তাতে তো রফতানি বাড়বে, দেশের উত্পাদন বাড়বে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের জবাব, এই পরিস্থিতিতে কখনওই চট করে রফতানি বাড়ার জায়গা তৈরি হয় না। সাধারণ অভিমত হল, ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ফলে বিশ্ববাজারে ইউরোপ ঘিরে একটা অনিশ্চয়তার জায়গা তৈরি হবে। সাবপ্রাইম ক্রাইসিস যা মার্কিন অর্থব্যবস্থাকে ধসিয়ে দিয়েছিল, সেখান থেকে বেরোতে না বেরোতেই পশ্চিম এশিয়ার সমস্যা একটা বড় আকার ধারণ করে। ২০০৭-’০৯ সালে যে মন্দা দেখা দিয়েছিল তাতে তার ঢেউ বিশ্ববাজারের প্রতিটি স্তরে আছড়ে পড়েছিল। ২০০৭-২০১৬ পর্যন্ত বিশ্ববাজার কিন্তু রাজনীতি এবং তার থেকে তৈরি হওয়া আর্থিক সমস্যা অথবা অন্য ভাবে দেখলে আর্থিক সমস্যা থেকে তৈরি হওয়া বিশ্ব রাজনীতির সমস্যা কিন্তু এখনও তাড়া করে ফিরছে। এই পরিস্থিতিতে ব্রেক্সিট কেবল মাত্র ব্রিটেনের একক সমস্যা থাকছে না। লন্ডন, যা এখনও বিশ্বের অর্থবাজারে অন্যতম কেন্দ্র এবং যে বাজার থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের বন্ড বিক্রি করার বড় জায়গা তৈরি হয়। সেই শহর কিন্তু এ সব বুঝেই সম্ভবত ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধেই ভোট দিয়েছে। যেহেতু এটা বিশ্বজুড়ে সমস্যা, সেই আঁচ কিন্তু ভারতও এড়াতে পারবে না।
ইউরোপের বাজার ধরার জন্য ভারতের সংস্থাগুলোর পছন্দের জায়গা ইংল্যান্ড। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, ইংল্যান্ডের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক, ভাষা নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য এবং অবশ্যই ব্যবসায়ীদের কাছে এটা একটা স্বস্তির জায়গা। এখান থেকেই ইউরোপের বাজার ধরতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ভারতের লগ্নিকারীরা। কিন্তু ইউরো জোট থেকে বেরিয়ে আসার ফলে ভারতের বাজার অনেকটাই মার খাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বৃহত্তর অর্থনীতির ক্ষেত্রেও কিন্তু সমস্যায় পড়বে। ভারতের রফতানি বাণিজ্য খুব একটা সুবিধার জায়গায় নেই। গত পাঁচ বছরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় টাকা সবচেয়ে নড়বড়ে মুদ্রা হিসাবে বিবেচিত। এই মুহূর্তে ভারত জোর দিচ্ছে কারখানায় উত্পাদিত পণ্য রফতানির উপর। সেই জায়গায় পৌঁছনোর পথে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে ব্রেক্সিট।
আগামী দিনে ইউরোপের বিশ্ববাজার এই নতুন ব্যবস্থার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবে। কিন্তু বাজার যদি হঠাত্ করে একটা নতুন ধাক্কার সম্মুখীন হয় তা হলে ভারত কী ভাবে তা মোকাবিলা করবে সেটা নির্ভর করবে স্কটল্যান্ড আদৌ ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে যাবে কি না। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কী ভাবে বাণিজ্য চুক্তি করবে তা বোঝা যাবে জোটের বাকি দেশগুলোর নাগরিকরা ব্রেক্সিটে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধিকার এবং সার্বভৌমত্ব— এই দুইয়ের জিগির তুলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর কী ধরনের চাপ সৃষ্টি করে তার পরিপ্রেক্ষিতে। এক কথায় আর্থিক এবং রাজনৈতিক সব দিক থেকে স্বাধিকার এবং সার্বভৌমত্ব গুলিয়ে ফেলার উপরে ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে সিলমোহর দিয়ে দিল তার প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী। মূল চিত্রটা এখনও স্পষ্ট না হলেও বিভাজিত বিশ্বের একটা ছবি কিন্তু ফুটে উঠছে। বিশ্বায়নের পক্ষে যারা তাদের কাছে এই দিকটা কতটা ভয়ানক সেটা আগামী দিন বলবে। কিন্তু জাতপাত নির্বিশেষে বিভাজনের পক্ষ যারা তাদের কাছে হয়তো এটা সোনার উদাহরণ। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব অর্থনীতি এড়াতে পারবে কি?
ভাবার কথা: বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে যাঁরা ভোট দিয়েছেন তাদের মধ্যে ষাটোর্ধ্বরাই দলে ভারী। যাঁরা তরুণ, ১৮-২৪ বছরের মধ্যে, যাঁদের সামনে পড়ে রয়েছে গোটা কর্মজীবনই, তাঁরা কিন্তু ব্রেক্সিট বিরোধিতায় গরিষ্ঠ।
আরও পড়ুন...
ব্রেক্সিট: ভারতের কি ক্ষতি হয়ে গেল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy