নোট-কাণ্ডের জেরে সঙ্কট কাটছে না চা বাগানে।
সমস্যার কবল থেকে বেরোতে না-পারার জন্য চা শিল্পমহল আঙুল তুলেছে এক এক সময়ে জারি হওয়া এক এক রকম সরকারি নির্দেশের দিকে। আর, তার জেরেই উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলিতে কর্মীদের বেতন দেওয়া নিয়ে নতুন সঙ্কটের আশঙ্কায় চা শিল্প। চা শিল্পের দাবি, কোনও মতে কিছু বাগানের কর্মীদের অক্টোবর ও নভেম্বরের প্রথম ১৫ দিনের বেতন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন নগদ জোগানের অভাবে এবং কিছু ব্যাঙ্কের ‘অসহযোগিতা’য় ফের বকেয়া বেতনের বোঝা চাপার আশঙ্কা বাগানগুলির। যা থেকে কর্মী অসন্তোষ ছড়ানোর আশঙ্কাও করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন (আইটিএ) জানিয়েছে, চা বাগানগুলির সঙ্গে লেনদেন রয়েছে, এমন ব্যাঙ্কগুলিকে নিয়ে গত ২১ নভেম্বর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের (আরবিআই) কলকাতার আ়ঞ্চলিক অধিকর্তা বৈঠক করেন। সেখানে ঠিক হয়, বাগানগুলির মূল ব্যাঙ্কই (এই শিল্পের পরিভাষায় ফিনান্সিং লিড-ব্যাঙ্ক) বেতনের টাকা দেওয়ার দায়িত্ব নেবে। ১৫ দিন অন্তর বাগানের প্রতিনিধি প্রয়োজনের প্রমাণ-সহ টাকা তুলতে পারবেন। এবং প্রতিটি বাগানের মোট এলাকার (হেক্টরে) সঙ্গে ২.৫ এবং ১৪০০ টাকা গুণ করে যে-অঙ্ক মিলবে, প্রতি ১৫ দিনে ওই বাগানটি সর্বোচ্চ সেই টাকাই তুলতে পারবে।
আইটিএ-র দাবি, এই নির্দেশের জেরে নতুন করে সমস্যা তৈরি হয়েছে। আইটিএ কর্তা অরিজিৎ রাহা এবং সুমন্ত্র গুহঠাকুরতা জানান, ধরা যাক একটি বাগানের লিড-ব্যাঙ্ক ‘ক’। যেটির শাখা হয়তো কলকাতায় বা শিলিগুড়িতে। কিন্তু কাছাকাছি এলাকায় বাগানটির অ্যাকাউন্ট রয়েছে ‘খ’ ব্যাঙ্কে। তাঁদের অভিযোগ, ‘খ’ ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে টাকা থাকলেও তা থেকে টাকা তুলতে পারছে না বাগানটি। তাদের বলা হচ্ছে, টাকা দেবে ‘ক’ ব্যাঙ্ক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো ওই ব্যাঙ্কের কোনও শাখা বাগানের আশপাশে নেই। আবার অনেক সময়ে আরবিআই বা রাজ্যের কাছ থেকে এমন কোনও নির্দেশ পায়নি বলে ‘ক’ ব্যাঙ্কও বাগানকে টাকা দিতে চায়নি। ফলে দুই ব্যাঙ্কে দৌড়দৌড়ি করতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা বাগান কর্তৃপক্ষের। কয়েক দিন ধরে এ নিয়ে আলাচনার পরে হয়তো লিড-ব্যাঙ্ক আরবিআই-এর নির্দেশের কথা মানলেও শেষে বলেছে, এখন টাকা নেই। অরিজিৎবাবু জানান, এ নিয়ে তাঁরা চিঠি দিয়েছেন রাজ্যের অর্থ সচিব এবং টি বোর্ডকে।
এখানেই শেষ নয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রের অভিযোগ, সরকারি নির্দেশের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকলে আমজনতার ভোগান্তির সীমা কোথায় পৌঁছয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে উত্তরঙ্গের কিছু চা বাগান। সুমন্ত্রবাবুর অভিযোগ, বেতন দিতে কতটা টাকা লাগবে তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য বাগানগুলিকে কর্মীদের ‘মাস্টার রোল’ দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কিছু ব্যাঙ্ক এখন কর্মীদের সচিত্র পরিচয়পত্রও দাবি করছে। না-হলে বাগানগুলির হাতে বেতনের টাকা দিতে চাইছে না তারা। সুমন্ত্রবাবু বলেন, ‘‘অনেকেরই পরিচয়পত্র না-ও থাকতে পারে। কিংবা বাগানের খাতায় ডাক-নামও লিখিয়ে থাকেন অনেকে। পরিচয়পত্রে পুরো নাম থাকে। নামের তারতম্যের জন্য আবার নতুন করে সমস্যা তৈরি হতে পারে।’’
তিনি জানান, বাগানের অফিস-কর্মীদের অক্টোবরের মাসিক বেতন এবং নভেম্বরে প্রথম ১৫ দিনের জন্য শ্রমিকদের সাপ্তাহিক মজুরি দেওয়া হয়েছে আপাতত। এখনও নভেম্বরের অর্ধেক মজুরি বাকি। নভেম্বরের মাসিক বেতন দেওয়ার সময়ও এসে গেল। তিনি বলেন, ‘‘দ্রুত নগদের জোগান না-বাড়ালে কর্মী-শ্রমিকদের বেতনে ফের বিপুল বকেয়া পড়বে।’’
সর্বোচ্চ টাকা তোলার যে-সীমা আরবিআই বেঁধে দিয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। অরিজিৎবাবু বলেন, ‘‘ধরে নেওয়া হচ্ছে, হেক্টর প্রতি বাগানে ২.৫ জন কাজ করেন। প্রকৃতপক্ষে যা বহু বাগানে অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে ওই সূত্র মেনে চললে ওই বাগানগুলি এমনিতেই চাহিদার চেয়ে কম টাকা পাবে।’’
সাধারণ ভাবে বাগানের শ্রমিকদের সপ্তাহান্তে মজুরি দেওয়া হয় নগদে। যাঁরা প্রশাসনিক কাজে যুক্ত সেই কর্মীরা মাসের বেতন পরের মাসের গোড়ায় পান। পুরনো নোট বাতিলের জেরে নগদের টানে সকলেরই বেতন আটকে গিয়েছিল। আরবিআই-এর একটি নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে অসম ও পশ্চিমবঙ্গের শ্রম দফতর প্রথমে জানিয়েছিল, জেলাশাসকদের অধীনে একটি সাধারণ অ্যাকাউন্টে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাগানগুলি টাকা স্থানান্তর করবে। তারপর প্রমাণ-সহ প্রয়োজন মতো সেখান থেকে টাকা তুলতে পারবে। কিন্তু এই নির্দেশেও এ রাজ্যের হাতেগোনা বাগানে টাকা পৌঁছলেও বাকিরা তা পায়নি বলে গত সপ্তাহে রাজ্যের মুখ্য সচিবের কাছে অভিযোগ করেছিলেন খোদ টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। পরে অবশ্য বিষয়টির কিছুটা উন্নতি হয় বলে দাবি আইটিএ-এর। তাদের দাবি, দার্জিলিং ও তরাই মিলিয়ে ৫১টি-রও বেশি বাগানে বেতনের টাকা পৌঁছেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy