Advertisement
০৪ মে ২০২৪

আপনিই অর্থমন্ত্রী

হেঁশেল থেকে কর্পোরেটের বোর্ডরুম। হেলায় সব সামলেও সঞ্চয়ে পরনির্ভরতা কেন? নিজে ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। বসুন আলোচনায়। আপনিই তো বাড়ির অর্থমন্ত্রী। লিখছেন শৈবাল বিশ্বাসমহিলাদের একেবারে নিজস্ব কিছু আর্থিক প্রয়োজন আছে। রয়েছে বিশেষ কিছু ঝুঁকি। টাকা জমানো ও তা বিভিন্ন প্রকল্পে ছড়িয়ে দেওয়ার সময়ে যা মাথায় রাখা জরুরি। আজকের আলোচনা সেই বিষয়েই।

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৮ ০১:৪৪
Share: Save:

মেয়েদের জন্য সঞ্চয়ের গুরুত্ব আলাদা ভাবে বললেই অনেকে প্রশ্ন করেন, এ বিষয়ে তাঁরা কি ছেলেদের থেকে আলাদা? উত্তর, হ্যাঁ এবং না, দু’টোই। কারণ, পুরুষ, মহিলা সকলকেই আয়ের একটি অংশ সঞ্চয় হিসেবে তুলে রাখতে হয়, এ কথা সত্যি। কিন্তু তেমনই এটাও ঠিক যে, মহিলাদের একেবারে নিজস্ব কিছু আর্থিক প্রয়োজন আছে। রয়েছে বিশেষ কিছু ঝুঁকি। টাকা জমানো ও তা বিভিন্ন প্রকল্পে ছড়িয়ে দেওয়ার সময়ে যা মাথায় রাখা জরুরি। আজকের আলোচনা সেই বিষয়েই।

তিন ভুবন

মহিলাদের জগৎকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক, গৃহবধূ (যাঁরা আর্থিক ভাবে স্বামীর উপরে নির্ভরশীল) কিংবা বাবা-মায়ের উপর আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল মহিলা। দুই, চাকরি করেন কিন্তু অবিবাহিতা। আর তিন, বিবাহিতা এবং চাকুরিরতা। এঁদের প্রত্যেকের আর্থিক চাহিদা এবং সঞ্চয়ের প্রয়োজন আলাদা। তাই তার সিদ্ধান্তও তেমনই হওয়া উচিত।

স্বতন্ত্র দুনিয়া

কয়েকটি উদাহরণ দিলে উপরের বিষয়টি একটু খোলসা হতে পারে—

• মাতৃত্বের কথাই ধরুন। সন্তানের জন্ম দেওয়া প্রায় সব মেয়ের সব থেকে কাঙ্ক্ষিত, ভাল লাগার মুহূর্ত। কিন্তু তেমনই এর জন্য হয়তো পেশাদারি জীবনে অনেকখানি ত্যাগও করতে হয়। অনেক সময়ই দেখা যায়, বাচ্চার জন্য সময় বার করতে গিয়ে নিজের কেরিয়ারের সঙ্গে আপোস করতে হচ্ছে। এই একই ঘটনা ঘটে বাড়ির বয়স্কদের দেখাশোনার জন্যও।

• জীবন বদলে যেতে পারে স্বামীর মৃত্যু হলে অথবা তাঁর সঙ্গে সম্পর্কে দাঁড়ি পড়লেও (ডিভোর্স)। মানসিক যন্ত্রণার কথা তো বাদই দিলাম। তার বাইরেও ঢেলে সাজাতে হয় নিজের আর্থিক পরিকল্পনা। বিশেষত কেউ যদি গৃহবধূ হন এবং পায়ের তলায় মাটি পাওয়ার মতো সঞ্চয় তাঁর হাতে মজুত না থাকে, তা হলে নতুন করে বাঁচার লড়াই শুরু করতে হয় তাঁকে। মহিলা হিসেবে সঞ্চয় পরিকল্পনা করার সময় এই অপ্রিয় অথচ বাস্তব সম্ভাবনাগুলোও মাথায় রাখা জরুরি।

বিয়ে না করে একা জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেও, আয় এবং সঞ্চয়ে শুরু থেকে স্বাবলম্বী হতে হবে।

• স্বাস্থ্য বিমা তো সকলেরই করা উচিত। কিন্তু মনে রাখবেন, ব্রেস্ট ক্যানসার কিংবা সার্ভিক্যাল ক্যানসারের মতো অসুখ হয় মেয়েদেরই। টাকা জমানোর পরিকল্পনার সময়ে এই সম্ভাবনাগুলিকেও ফেলে দেবেন না।

আর্থিক জগৎ চিনুন

মহিলারা সংসার সামলান। কিন্তু ব্যাঙ্কের পাসবই কিংবা বিমার কাগজের হদিস রাখতে এখনও তাঁদের অনেকের তীব্র অনীহা। যেন ও সমস্ত কাজ একান্ত ছেলেদেরই। ব্যাঙ্কে উঁচু পদে কাজ করা অনেক মহিলাকেও এমনটা ভাবতে দেখেছি। শুরুতেই বলব, এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন। কী ভাবে কোথায় সঞ্চয় করবেন, ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে কী কী সুবিধা মেলে, এই সব জানা থাকলে প্রয়োজনের সময় অসুবিধা হয় না। নইলে কিন্তু বিপদের দিনে আতান্তরে পড়বেন। এ বিষয়ে কয়েকটি ছোট্ট কথা মাথায় রাখুন—

• উপস্থিতি: আর্থিক পরিকল্পনার সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আলোচনায় আপনার উপস্থিতি জরুরি। কোথায়, কত টাকা রাখা হচ্ছে, তা জানা জরুরি।

• প্রশ্ন করুন: যতক্ষণ না বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে, ততক্ষণ প্রকল্পের সুবিধা-অসুবিধা, ভাল-মন্দ নিয়ে প্রশ্ন করুন।

• সঙ্গী হোন: সঞ্চয়সঙ্গী হওয়াও কিন্তু দরকার। দেখুন, টাকা রাখার সময়ে আপনার নাম জয়েন্ট হোল্ডার বা নমিনি হিসেবে রয়েছে কি না। না থাকলে কথা বলে সেই ব্যবস্থা করুন।

• রাখুন কাগজপত্র: বিমা, পিপিএফ, ব্যাঙ্কের পাসবই, শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ডের মতো সঞ্চয়ের নথি নিজের জিম্মায় রাখুন। যাতে কখনও তা খুঁজতে গিয়ে হাতড়াতে না হয়।

• ক্লেম কী ভাবে: কোনও প্রকল্পে টাকা দাবি করতে হলে অথবা মেয়াদ শেষে তা হাতে পেতে কী করতে হবে, তা জেনে রাখুন। সেই পদ্ধতি খাতায় লিখেও রাখতে পারেন। তুলে রাখুন এজেন্টের ঠিকানা, ফোন নম্বরও।

• উইল একসঙ্গে: উইল বা দানপত্র করার সময়ে স্বামী-স্ত্রী বসে আলোচনা করুন। দেখবেন, যেন আপনাকে ছাড়া উইল তৈরি না হয়। বিশেষত বয়স্ক মায়ের প্রতি ছেলে-মেয়ের অবহেলার খবর যে ভাবে নিয়মিত শোনা যাচ্ছে।

গৃহবধূর সঞ্চয়

এটা ঠিক যে হাতে আসা টাকার পরিমাণ হয়তো আপনাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে কিছুটা কম। তাই টাকা হাতে এলেই তার কিছুটা জমিয়ে রাখতে হবে। এ জন্য নীচের বিষয়গুলি মাথায় রাখুন—

• বেছে নিন সেভিংস অ্যাকাউন্টকে। কারণ, বাড়িতে রাখলে সেই টাকায় সুদ পাওয়া যাবে না। কিন্তু ব্যাঙ্কে অন্তত ৩.৫% সুদ পাবেন। প্রথমে সঞ্চয়ের অভ্যেসটা তৈরি করুন।

• রোজগেরে স্বামীর কিছু হলে, সবচেয়ে সমস্যায় পড়বেন স্ত্রী এবং সন্তানরাই। তাই বিয়ের পরেই স্বামীকে বলুন মোটা অঙ্কের জীবন বিমার ব্যবস্থা করতে। এ ক্ষেত্রে টার্ম পলিসির কথা ভাবতেই পারেন।

• ভাবুন স্বাস্থ্য বিমার কথাও। যদি স্বামীর আগে থেকে সেটি থাকে, তাহলে সেই প্রকল্পকে ফ্ল্যামিলি ফ্লোটারে বদলিয়ে আপনার নাম ঢোকাতে বলুন। সন্তান হলে, তাকেও এই প্রকল্পে আনতে হবে।

• সেভিংসে টাকা রাখলে সুদ পাবেন ঠিকই। কিন্তু তা দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি জোঝা শক্ত। তাই ভাবুন অন্য লগ্নির কথাও। সে ক্ষেত্রে হাতে আসা থোক টাকা রাখতে পারেন ব্যাঙ্ক, ডাকঘরের স্থায়ী আমানত বা রেকারিং ডিপোজিটে। এ ক্ষেত্রে সুদের হার তুলনায় বেশি। আর যদি বয়স কম হয় এবং সামান্য ঝুঁকি নিতে রাজি থাকেন, তা হলে বাছতে পারেন ইকুইটি ফান্ড।

• স্বামীও যাতে নিয়মিত লগ্নি করেন, সে দিকে নজর দিন। তা করতে হবে লক্ষ্য বেঁধে। অবসর জীবনের তহবিল, সন্তানের পড়াশোনা ইত্যাদি। দু’জনে মিলে বাজে খরচের অভ্যাস ছেঁটে ফেলার শপথ নিলে মন্দ হয় না।

• জিনিসপত্রের দাম যে ভাবে বাড়ছে, তাতে এখন একার পক্ষে সংসার চালানো অনেক ক্ষেত্রে কঠিন। চাইলে আপনিও কিছু বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন। চাকরি করলে এক কথা, নইলে নিজের দক্ষতা মেপে অন্তত বাড়িতে বসে কিছু রোজগারের কথা ভাবুন। যেমন, টিউশন, আঁকা শেখানো, গ্রাফিক্স ডিজাইন, অল্পবিস্তর লেখালিখি, ছোটখাটো কেটারিংয়ের ব্যবসা ইত্যাদি।

বিয়ের পরেও চাকরি

এঁদের লগ্নির ধরন কিছু হলেও আলাদা। কারণ, হাতে টাকার জোগান তুলনায় বেশি এবং নিয়মিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা যায়, অনেকে লগ্নির কথা সে ভাবে ভাবেন না। সেভিংসেই টাকা পড়ে থাকে। নিজের সঞ্চয়ের ডালি সাজাতে মাথায় রাখুন—

• চাকরি বজায়: অনেক সময় বিয়ে বা সন্তানের জন্মের পরে চাকরি ছেড়ে দেন মহিলারা। আমি বলব, তা না করাই ভাল। বরং চেষ্টা করুন কী ভাবে দু’দিক সামলানো যায়। তা পারলে, গৃহবধূদের দেওয়া পরামর্শগুলি তো মেনে চলতেই হবে। সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে বাড়তি কিছু কথা।

• কথা বলুন: আর্থিক পরিকল্পনা তৈরিতে উদ্যোগী হোন। স্বামীর সঙ্গে বসে ঠিক করুন কোথায় কত রাখবেন। নিজের যুক্তিতে আস্থা রাখুন।

• জীবনবিমা করুন: আপনিও রোজগেরে। ফলে নিজের জন্য টার্ম পলিসি করুন। সাধারণত বছরের বেতনের ১৫ গুণ টাকার পলিসি কিনতে বলি। লক্ষ্য হবে, আপনার কিছু হলেও সন্তানের পড়াশোনা ইত্যাদি যাতে আটকে না থাকে।

• জোর স্বাস্থ্য বিমায়: আগেই বলেছি, কিছু শারীরিক সমস্যা শুধুমাত্র মহিলাদেরই হয়। সে জন্য স্বাস্থ্য বিমায় আলাদা করে রাইডার নিন। অনেক সময়ে মাতৃত্বকালীন এবং সন্তানের চিকিৎসারও আলাদা সুবিধা দেয় বিমা সংস্থাগুলি। সেই সমস্ত প্রকল্প নিয়ে খোঁজখবর করুন।

• বিপদের সঞ্চয়: বিপদ বলেকয়ে আসে না। স্বামীর মৃত্যুই হোক বা বিচ্ছেদ। হঠাৎ বিপদের কথা মাথায় রেখে জমানো শুরু করুন চাকরি জীবনের প্রথম দিন থেকেই। বিয়ের পরে এর গুরুত্ব আরও বাড়বে।

• লক্ষ্য বেঁধে লগ্নি: অবসর তহবিল, সন্তানের শিক্ষা, তার বিয়ে, বেড়াতে যাওয়া, বাড়ি কেনা— এ সবের জন্যই স্বামীর সঙ্গে মিলে তহবিল তৈরি করতে হবে। সাধারণত মেয়েরা তুলনায় সুরক্ষিত প্রকল্পে টাকা রাখতে বেশি স্বচ্ছন্দ। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধিকে হারাতে ফান্ডে এসআইপি পদ্ধতিতে টাকা রাখার কথা ভাবতেই পারেন। প্রথমেই শেয়ার বাজারে পা রাখতে বলব না। কিন্তু ধীরে ধীরে বাজার সম্পর্কে সড়গড় হলে, সেই পথেও হাঁটতে পারেন।

• অবসরের তহবিল: আলাদা করে এর কথা বলছি। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পরেও স্ত্রী বেঁচে থাকেন। তখন সন্তানরা দায়িত্ব নিতে রাজি না-ও হতে পারে। তখন বিপুল হতে পারে চিকিৎসার খরচ। তাই সেই সব ভেবে অবসর জীবনের জন্য মোটা তহবিল তৈরিই বুদ্ধিমানের কাজ।

এ জন্য যত আগে লগ্নি শুরু করবেন, তত ভাল। ২৫ বছরের এক জন মেয়ে মাসে ৩,১০০ টাকা করে এসআইপি করলে, ৬০ বছর বয়সে গিয়ে তাঁর তহবিল দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি টাকা (গড় রিটার্ন ১২% ধরে)। কিন্তু ৪৫ বছরের কেউ ওই একই পরিমাণ অর্থ জমাতে চাইলে, তাঁকে প্রতি মাসে জমাতে হবে ৪০,০০০ টাকা। অর্থাৎ, প্রথম থেকে শুরু করলে অল্প লগ্নিতেও বড় তহবিল গড়ে তোলা সম্ভব।

বিয়ের থেকে দূরে

যাঁরা এখনও বিয়ে করেননি কিন্তু পরে করবেন এবং যাঁরা ছাদনাতলায় যেতেই চান না, তাঁদেরও সঞ্চয় কৌশল নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেওয়া ভাল।

প্রথম ক্ষেত্রে নিজের ভবিষ্যতের সঞ্চয় ছাড়াও, বিয়ের তহবিল তৈরি করতে হবে। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তো রাখতে হবেই, সেই সঙ্গে সংসারের দায়িত্বও মাথায় নিতে হবে। ফলে প্রথম থেকেই সেই অনুসারে তৈরি হওয়া জরুরি।

লেখক: বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ

(মতামত ব্যক্তিগত)

পরামর্শের জন্য লিখুন:

‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।

ই-মেল: bishoy@abp.in

ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

savings Housewife
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE