Advertisement
১১ মে ২০২৪

কুবের উবাচ

ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়া কতটা জরুরি, তা উৎপলের প্রোফাইল দেখলে বোঝা যায়। এই অভ্যাস তৈরির জন্য প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত ছোটবেলাতেই সন্তানকে একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া। হাত খরচ বাঁচিয়ে সেখানে টাকা জমা করতে উৎসাহ জোগানো। উপহার হিসেবে টাকা পেলেও সেটা অ্যাকাউন্টে ফেলতে শেখানো।

শৈবাল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৬ ০২:৫৩
Share: Save:

উৎপল (৩৭) • স্ত্রী (৩২) • ছেলে (২) • বাবা (৭৪) • মা (৬৮)

বহুজাতিক সংস্থার কর্মী • বাস মুম্বইয়ে • মা-বাবা থাকেন হাওড়ায়, নিজেদের বাড়িতে
• কলকাতায় ফ্ল্যাট • লক্ষ্য, ছেলের শিক্ষার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ লক্ষ জমানো
• অবসরের ২ কোটি সঞ্চয় গড়ে তোলা • ইচ্ছে, মুম্বইয়ে ২০ লক্ষ টাকার ফ্ল্যাট কেনার

ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়া কতটা জরুরি, তা উৎপলের প্রোফাইল দেখলে বোঝা যায়। এই অভ্যাস তৈরির জন্য প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত ছোটবেলাতেই সন্তানকে একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া। হাত খরচ বাঁচিয়ে সেখানে টাকা জমা করতে উৎসাহ জোগানো। উপহার হিসেবে টাকা পেলেও সেটা অ্যাকাউন্টে ফেলতে শেখানো।

উৎপলের এই সঞ্চয়-অভ্যাসই আমায় মুগ্ধ করেছে। বুঝতে পারছি, এটা ওর বাবা-মায়ের শিক্ষা। উৎপল প্রথম ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলেন ১২-১৪ বছরে। ১৮ বছর থেকে তাতে টাকা রাখছেন নিয়ম করে। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া সঞ্চয় ও লগ্নির এই অভ্যাসে ভর করে তিনি পরবর্তীকালে যে ভাবে এগিয়েছেন, সেটা কিন্তু উৎপলের বয়সী অনেকের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায় না। আমরা এখানে তাঁর বিমা, সম্পদ ও লগ্নি প্রোফাইল খতিয়ে দেখব। আর সেই সঙ্গেই জেনে নেব তাঁর ইচ্ছে পূরণের উপায়।

স্বাস্থ্যবিমা

উৎপল সংস্থা থেকে স্বাস্থ্যবিমা পান। কিন্তু শুধুমাত্র সেটার উপর উনি নির্ভর করে থাকেননি। স্ত্রী, সন্তান-সহ নিজের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যবিমা কিনেছেন। ঠিক এটাই তো করা উচিত। তবে আগামী দিনে তাঁকে বিমার অঙ্ক আরও বাড়াতে হবে। অন্তত মূল্যবৃদ্ধির হারে তো বটেই।

জীবনবিমা

আমি বারবার টার্ম পলিসির কথা বলি। যা প্রকৃত অর্থে পরিবারকে সুরক্ষার ছাতার তলায় রাখে। বিমাকারীর মৃত্যু হলে হাতে আসা বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিয়ে পরিবারের ভেসে যাওয়া আটকানো যায়। তবে উৎপল আরও এক ধাপ এগিয়ে ভেবেছেন।

বিমাকারী মারা গেলে কী হবে, সে কথা ভেবে তো টার্ম পলিসি করা হল। কিন্তু যদি মারা না-গিয়ে অক্ষম হয়ে পড়েন? যদি দুরারোগ্য অসুখ ধরা পড়ে? তখনও তো আয় বন্ধ হতে পারে। তা হলে?

জীবনের বিভিন্ন মোড়ে যে যে দুর্ঘটনা ঘটলে পরিবার বিপদে পড়তে পারে, বিমা করার সময়ে তার সব কিছুই মাথায় রাখতে হয়। যেমন, দুর্ঘটনায় মৃত্যু। যা কম বয়সেই হতে পারে। তাই টার্ম পলিসির বিমামূল্যের উপর এই খাতে বাড়তি বিমা যোগ করা উচিত। আবার সব দুর্ঘটনা প্রাণ নেয় না। সারা জীবনের মতো পঙ্গু করে রাখে। সেই ঝুঁকি কমানোর ব্যবস্থাও বিমাকারীকে করতে হয়। তা ছাড়া, ক্যান্সার, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো অসুখের চিকিৎসা শুধু খরচসাপেক্ষ তা-ই নয়, এগুলি কাজ করার ক্ষমতাও কেড়ে নেয়। বাড়তি রাইডার হিসেবে বা আলাদা বিমা করে এই ঝুঁকি কমানো জরুরি। উৎপল টার্ম পলিসিকে হাতিয়ার করে ও কম প্রিমিয়ামের সুযোগ নিয়ে জীবনবিমা করার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার প্রায় প্রতিটি দিককে ছুঁয়ে গিয়েছেন।

স্ত্রী ও নিজের জন্য সরকারি বিমাও কিনেছেন তিনি। একক ভাবে দেখলে সেগুলি ছোট মাপের। তবে অন্যান্য পলিসির সঙ্গে এক ফ্রেমে রাখলে বাড়তি বিমামূল্য যোগ করার মতো।

তবে নিজেকে ও পরিবারকে যিনি এত সুরক্ষিত রেখেছেন, তাঁর ঝুলিতে ঋণপত্র নির্ভর (ডেট) বিমা প্রকল্প কেন? যদি দেখেন সেগুলিতে ভাল রিটার্নের সম্ভাবনা রয়েছে, তা হলে ধরে রাখা যায়। না হলে পেড আপ বা সারেন্ডার করা ভাল। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন।

সম্পদ

আমি ফ্ল্যাট কিনে খালি ফেলে রাখার পক্ষপাতী নই। ভাড়া দিলে আয়ের সংস্থান হতে পারে। কিন্তু ফেলে রাখলে রক্ষণাবেক্ষণের খরচ পকেট থেকে খসে। এটা বাজে খরচ। অথচ অনেকেই ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে দোনামোনা করেন। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের চিরাচরিত দ্বন্দ্বের ইতিহাস হয়তো এর কারণ। তবে এখন এ ব্যাপারে আইন অনেক পোক্ত। কত দিনের জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, কত টাকা দিতে হবে, এই সব কিছুই আইন মাফিক আগে থেকে বেঁধে রাখা হয়। যা মানতে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটে, দু’পক্ষই বাধ্য। কাজেই উৎপলের উচিত ১১ মাসের চুক্তি করে সেটিকে ভাড়া খাটাতে থাকা। প্রত্যেক ১১ মাস অন্তর চুক্তি করতে-করতে এগোলে ঝুঁকি কম থাকবে। এর থেকে হাতে যে টাকা আসবে, সেটার কিছুটা দিয়ে রেকারিং ডিপোজিট ও বাকিটা দিয়ে এসআইপি করা যায়।

বিনিয়োগ

লগ্নির প্রায় সব ধরনের ক্ষেত্রেই তহবিল ছড়িয়ে দিয়েছেন উৎপল। তবে কতটা শেয়ারে ঢালবেন, আর কতটা ঋণপত্রে, সেটা নিয়ে একটু দ্বিধায়।

শেয়ার ও ঋণপত্রে টাকা খাটানোর বিষয়টা পুরোপুরি লগ্নিকারীর বয়স ও ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে একটা সহজ নিয়ম রয়েছে। নিজের বয়সকে ১০০ থেকে বাদ দিন। যেটা পাবেন, তহবিলের ততটা অংশ শেয়ার বাজারে খাটানো উচিত। বাকিটা ডেট বা ঋণপত্র ভিত্তিক লগ্নি ও গোল্ড ইটিএফে।

উৎপলের বয়স ৩৭ বছর। সুতরাং এখন তাঁর তহবিলের ৬৩% শেয়ারে লগ্নি করা উচিত। বাকি ৩৭% ঋণপত্রে। বয়স যত বাড়বে শেয়ারে খাটানোর তহবিল তত কমবে। বাড়বে ঋণপত্রে লগ্নির বরাদ্দ।

অবশ্য ঝুঁকি বইবার ক্ষমতার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে। প্রশ্ন হল, এই ঝুঁকি কি উৎপলকে একটু মানসিক ভাবে নড়বড়ে করে দেয়? তা হলে বলব অকারণ চাপ না নেওয়াই ভাল। শেয়ারে ততটাই ঢালতে হবে, যতটাতে তিনি স্বচ্ছন্দ। তবে মাথায় রাখতে হবে, বেশির ভাগ ঋণপত্র ভিত্তিক লগ্নি কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির হারের তুলনায় কম রিটার্ন দেয়। সুতরাং তাতে সম্পদ আপনার মনের মতো বাড়বে না। ফলে সেই তহবিলের উপর কতটা ভরসা রাখা যাবে, তা নিয়ে কিন্তু সন্দেহ থেকেই যায়।

নিট আয় (মাসে) ৫৬,০০০ • খরচ (মাসে) সংসার ১০,০০০ • বাড়ি ভাড়া ৬,০০০ • স্বাস্থ্যবিমা ও টার্ম পলিসি ১,৩৩৩ • সঞ্চয় (মাসে) পিএফ ৬,০০০ • জীবনবিমা ২,৫০০ • পিপিএফ ১২,৫০০ • এনপিএস ২,০৮৩ • আরডি ৪,৫৮৩ • মিউচুয়াল ফান্ড ২,০৮৩ • শেয়ার, ফান্ড মিলিয়ে ১৪,৯১৬ • সম্পদ পিপিএফ ৭,২০,০০০ • এফডি ও আরডি ৭,৫০,০০০ • এলআইসি বোনাস ২,০০,০০০ • ইপিএফ ২,০০,০০০ • এনপিএস ২৫,০০০ • শেয়ার ১,৫০,০০০ • মিউচুয়াল ফান্ড ২৫,০০০ • সেভিংস অ্যাকাউন্ট ১,০০,০০০ • ফ্ল্যাট ২০,০০,০০০

লক্ষ্য পূরণ

উৎপল শেয়ারে করা লগ্নির পুরোটাই সন্তানের শিক্ষায় লাগাতে চান। আমার মতে, ৩০ লক্ষের পুঁজি এখান থেকেই উঠে আসবে। তবে একটা বিষয়ে তাঁর কৌশলের সঙ্গে আমি একমত নই। শেয়ারে লগ্নি দিয়ে শুধু সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় কেন? অবসর জীবনের সঞ্চয় তৈরি কেন নয়? দু’টিই দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য। এবং সব দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য পূরণেই শেয়ারে বিনিয়োগকে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি, এসআইপি-র মতো অল্প অল্প করে অনেক বড় তহবিল গড়ার বন্দোবস্ত তো আছেই।

উৎপল নিজেই ওনার ইকুইটি এবং ইকুইটি ভিত্তিক মিউচুয়াল ফান্ড লগ্নি সামলান। নিশ্চয়ই প্রত্যেক মাসে তিনি আগে দেখে নেন নিজের হাতে কতটা তহবিল বাড়তি থাকছে, তার পরে সেই অনুযায়ী নির্দিষ্ট টাকা শেয়ারে খাটান।

মুম্বইয়ে ফ্ল্যাট কেনার প্রসঙ্গে বলব, ব্যাঙ্ক-ঋণ নিয়ে কিনতে পারেন। তেমন হলে ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে ঋণের পরিমাণ কমিয়েও নিতে পারেন। তবে উৎপল এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, তাতে এ ভাবে আর একটি ফ্ল্যাট কেনা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। কলকাতার ফ্ল্যাট বিক্রি করে, সেই টাকা দিয়ে নতুন একটি কিনলে অবশ্য কিছু বলার নেই। দু’টিরই বর্তমান মূল্য প্রায় এক। ফলে ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপবে না। তা ছাড়া, সুবিধা আরও আছে। কলকাতার ফ্ল্যাট বেচলে মূলধনী লাভকর দিতে হবে। কিন্তু বিক্রির টাকা দিয়ে দ্রুত নতুন ফ্ল্যাট কিনে নিলে সেই কর লাগবে না।

মনে রাখুন

লক্ষ্য পূরণে অবিচল থাকতে উৎপলকে যে বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হবে, সেগুলি হল—

বিভিন্ন দিকে লগ্নি ছড়িয়ে দিলে, হিসেব রাখা বা তাদের উপর নিয়মিত নজরদারির সমস্যা হয়। অথচ বিনিয়োগে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এগুলি জরুরি।

শেয়ার বাজারে ওঠা-নামা থাকবেই। এ নিয়ে আতঙ্কিত না-হয়ে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে মাথা ঠান্ডা রেখে।

ইকুইটির লগ্নি সন্তানের শিক্ষায় লাগানোর পন্থা চালিয়ে গেলে ভাল।

অবসরের জন্য টাকা জমাতেও বাজারের লগ্নিকে ব্যবহার করতে হবে। এসআইপি করাও জরুরি।

কলকাতার ফ্ল্যাট বেচার টাকা দিয়ে মুম্বইয়ে ফ্ল্যাট কিনলে উৎপলের লাভ। বাড়ি ভাড়ার খরচ বাঁচবে। অথচ পকেটে তেমন চাপ পড়বে না।

সব শেষে বলব, উৎপলের পোর্টফোলিও ভাল লেগেছে। ছোট ছোট কয়েকটি বদল আনলে তা আরও বেশি উপযোগী হয়ে উঠবে।

পরামর্শদাতা বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ

(মতামত ব্যক্তিগত)

অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত

ছবি: প্রতীকী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saibal biswas investment advice
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE