Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পদ্মাপারে তথ্যপ্রযুক্তি-লগ্নিতে কাঁটা উৎকণ্ঠা

লাভের লক্ষ্মী ছেড়ে যায়নি। দ্রুত বাড়ছে বাজারও। কিন্তু বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকে কাঁপিয়ে দিয়েছে হোলি আর্টিজান বেকারির হামলা। যে কারণে ভারত থেকে সেখানে গিয়ে ব্যবসা করা তথ্যপ্রযুক্তি এবং উপদেষ্টা সংস্থাগুলিও মনে করছে, অন্তত স্বল্প মেয়াদে ওই পড়শি মুলুকে ধাক্কা খাবে তাদের লগ্নি পরিকল্পনা।

গার্গী গুহঠাকুরতা শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৬ ০২:৪৭
Share: Save:

লাভের লক্ষ্মী ছেড়ে যায়নি। দ্রুত বাড়ছে বাজারও। কিন্তু বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকে কাঁপিয়ে দিয়েছে হোলি আর্টিজান বেকারির হামলা। যে কারণে ভারত থেকে সেখানে গিয়ে ব্যবসা করা তথ্যপ্রযুক্তি এবং উপদেষ্টা সংস্থাগুলিও মনে করছে, অন্তত স্বল্প মেয়াদে ওই পড়শি মুলুকে ধাক্কা খাবে তাদের লগ্নি পরিকল্পনা। নিরাপত্তা নিয়ে সারাক্ষণ ঘিরে থাকা উৎকণ্ঠাই কাঁটাতার হয়ে দাঁড়াচ্ছে ব্যবসার পথে। এতটাই যে, বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সিকিউরিটি অফিসারও পাঠাচ্ছে কয়েকটি সংস্থা।

যেমন, কলকাতার সংস্থা গ্লোবসিনের কর্ণধার বিক্রম দাশগুপ্ত বলছেন, ‘‘উৎকন্ঠা নিয়ে কাজ করা কঠিন। ঢাকায় হামলার জেরে বাংলাদেশে অন্তত সাময়িক ভাবে ধাক্কা খাবে বিদেশি বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত। কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়েই প্রশ্ন থাকলে, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব।’’ উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার দেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের রোডম্যাপ তৈরির দায়িত্বে ছিলেন বিক্রমবাবু। ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের বাছাই করা প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প উপদেষ্টার পদে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৮ সাল পর্ষন্ত সেই দায়িত্ব সামলানোর কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ওই পদ থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন তিনি। শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মৌলবাদী হামলাও যার অন্যতম কারণ।

ঢাকা বাংলাদেশে ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র। তার সবচেয়ে অভিজাত এবং ‘নিরাপদ’ এলাকায় বিদেশিদের উপর এমন নির্মম হানা টলিয়ে দিয়েছে সেখানে ব্যবসা করা বিদেশি তথ্যপ্রযুক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর পরিষেবা ও উপদেষ্টা সংস্থাগুলিকে। বাজারের টানে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ভিড় জমিয়েছে টিসিএস, আইবিএম, অ্যাকসেঞ্চার, উইপ্রোর মতো তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। ডিজিটাল বাংলাদেশ-সহ বিভিন্ন ই-গভর্ন্যান্স প্রকল্পে সরকারি বরাত পেতে একই পথে হাঁটছে এ পার বাংলার ছোট-মাঝারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি। কিন্তু জঙ্গি হানার পরে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা আপাতত শিকেয় তুলে রাখছে তারা। কারণ, বড় সংস্থার মতো পকেটের জোর না-থাকায় বাংলাদেশের প্রকল্পে গিয়ে কাজ করার মতো কর্মী জোগাড় করাই কঠিন হচ্ছে তাদের পক্ষে।

ভারতে ন্যাসকমের পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা নিরুপম চৌধুরীর মতে, স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা অবশ্যই কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘তথ্যপ্রযুক্তিতে লগ্নি টানতে বেশ কিছু সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় সেই সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে চট করে ও দেশে যেতে চাইছেন না কোনও লগ্নিকারী।’’

তথ্যপ্রযুক্তির পাশাপাশি ব্যবসার টানে বাংলাদেশে পা রেখেছে বিশ্বের চার নামী উপদেষ্টা সংস্থাও (পিডব্লিউসি, কেপিএমজি, ডেলয়েট ও আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং)। ঢাকায় নৃশংস জঙ্গি হামলা যেখানে ঘটেছে, সেই গুলশনেই মাত্র দশ মাস আগে নিজেদের কেন্দ্র খুলেছে পিডব্লিউসি। সেখানে ৪৫ জন কর্মীর মধ্যে ১৫ জন বাংলাদেশি। বাকি ৩০ জন ভারতীয়। বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ সামলাতে মূলত কলকাতা থেকে ঢাকা যান তাঁরা। কিন্তু হামলার জেরে আপাতত তাঁদের ঢাকায় যাওয়া বন্ধ রেখেছে সংস্থা। পিডব্লিউসি সূত্রে খবর, এখন ইদের ছুটি। কিন্তু ছুটি শেষেও অফিস কবে খুলবে বা ব্যবসা কী ভাবে চালানো হবে, সেই সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী সপ্তাহে ঢাকায় গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবেন সংস্থার গ্লোবাল সিকিউরিটি অফিসার। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ঠিক হবে পরবর্তী পদক্ষেপ।

তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যবসা করতে গিয়ে যে যথেষ্ট সমস্যা হচ্ছে, তা মেনে নিচ্ছেন সংস্থা কর্তৃপক্ষ। ১৫ জুলাই বাংলাদেশে আয়কর জমার শেষ দিন। সেখানে বেশ কিছু সংস্থার কর সংক্রান্ত কাজকর্ম সামলায় পিডব্লিউসি। কিন্তু এই শেষ মুহূর্তেও ই-মেল চালাচালি করেই তা সারতে হচ্ছে তাদের।

কোনও বড় শহরে জঙ্গি হানা এই প্রথম নয়। বরং উদাহরণ ভুরিভুরি। তা সে নিউ ইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা হোক বা লন্ডনে লাদেন-হানা। খাস ভারতই সাক্ষী বাণিজ্য-রাজধানী মুম্বইয়ে ২৬/১১-র রক্তক্ষয়ের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবারই এ ধরনের হামলার পরে সেখানকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশয় তৈরি হয়েছে এর ফলে সেখানে লগ্নিতে ভাটা পড়বে কি না, তা নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশকে এর জন্য খেসারত কিছুটা বেশিই গুনতে হচ্ছে বলে মনে করছেন তাঁরা। তাঁদের যুক্তি, একে উন্নয়নশীল দুনিয়ার দেশ, তার উপরে আড়েবহরে ছোট। তাতে আবার আঘাত এসেছে খাস ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত অঞ্চলে। স্বাভাবিক ভাবেই তাই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বিদেশি লগ্নি সরে যাওয়া নিয়ে।

বস্ত্রশিল্পের জন্য বাংলাদেশকে এক ডাকে চেনে সারা দুনিয়া। আমেরিকার নাইকি থেকে জাপানের ইউনিকিউলো। প্রায় সব বহুজাতিকের জামা-কাপড়ে সেলাই পড়ে পড়শি মুলুকের কারখানায়। বছরে শুধু রফতানির অঙ্কই ২,৬০০ কোটি ডলার (১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা)। এ হেন দাপুটে বস্ত্রশিল্পও হামলার পরে লগ্নি চলে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগে। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি তো সবে ডানা মেলছে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, তাদের চিন্তা বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।

উপদেষ্টা বহুজাতিক কেপিএমজি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিল্পের বাজারের মাপ ছিল ২৫ কোটি ডলার। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, গত পাঁচ বছরে তা লাফিয়ে বেড়েছে। সৌজন্যে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্প ও ৬০টি ব্যাঙ্কের উপস্থিতি। সবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করা বাংলাদেশের অর্থনীতির মতোই সদ্য দৌড় শুরু করা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পও সেখানে ধাক্কা খেতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা।

তবে এত কিছুর মধ্যেও আশার আলো দেখছেন কেপিএমজি-র অন্যতম কর্তা অম্বরীশ দাশগুপ্ত। তাঁর মতে, সংস্থাগুলির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এই হামলা বিশেষ প্রভাব ফেলবে না। কারণ, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন নজরকাড়া। সেখানে বাজার বাড়ছে দ্রুত। তা ধরতেই সে দেশে অফিস খুলছে বিভিন্ন সংস্থা। যদি একের পর এক হামলা চলতেই থাকে, তবে অন্য কথা। নইলে শুধু একটি হামলার কারণে বিভিন্ন সংস্থার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাতিল হবে না বলেই তাঁর ধারণা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

IT investment bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE