জীবনটা তো আসলে ছোট-বড় নানান লক্ষ্যের সমষ্টি। সেই লক্ষ্যভেদ করতে সারাটা সময় পরিকল্পনা করে এগোতে হয় আমাদের সকলকে। জীবন বিমা, স্বাস্থ্য বিমা, বিদেশে বেড়াতে যাওয়া, অবসর জীবনের জন্য সঞ্চয় তো আছেই। আবার সংসার খরচের হিসেব আমরা কষে ফেলি মাসের গোড়াতেই। কিন্তু যে কোনও মা-বাবার কাছে সবচেয়ে বড় লক্ষ্য অবশ্যই সন্তানকে বড় করা। নিজের পায়ে দাঁড় করানো। তার স্বপ্ন পূরণের সাঁকো বাঁধা। আমাদের মা-বাবাও তো ঠিক এটাই করে এসেছেন। এ বার আমাদের পালা।
যে কোনও মানুষের কাছেই জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত সম্ভবত সন্তানের মুখ দেখা। তার পর থেকে প্রতিটি দিনই তাঁকে চলতে হয় মেপে মেপে। তাকে বড় করা, লেখাপড়া শেখানো, বিয়ে দেওয়া— সন্তানের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি বাঁকেই আলো ফেলেন মা-বাবা।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত পথই কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। পড়াশোনার খরচ বেড়ে হচ্ছে আকাশ ছোঁয়া। ভবিষ্যতে তার নাগাল পেতে যথেষ্ট মাথা ঘামাতে হবে। তবে সৌভাগ্যবশত, সেই খরচ সামলানোর জন্য এখন অনেক রকম লগ্নির সুযোগও তৈরি হয়েছে। তবে যেখানেই লগ্নি করুন না কেন, সেটা শুরু করা উচিত যথেষ্ট আগে থেকে।
এটা ঠিক যে, সেরা ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগের অভাব নেই এখনও। সেরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। আছে স্কলারশিপও। কিন্তু সে তো জোটে হাতে গোনা কয়েক জনের কপালে। বাকিদের সম্বল তো লড়াই। সন্তানের সেই লড়াইয়েই প্রতিটি মুহূর্ত সঙ্গ দিতে হয় মা-বাবাকে।
শুভস্য শীঘ্রম
কত দিন ধরে লগ্নি করবেন তা পুরোপুরি নির্ভর করছে আপনি কখন লগ্নি করা শুরু করছেন তার উপরে। যদি তাড়াতাড়ি শুরু করতে পারেন তা হলে হাতে অনেক ধরনের সুযোগ রয়েছে। যেমন, শেয়ার বাজারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ইকুইটি স্কিমগুলিতে লগ্নি করতে পারলে বড় রিটার্নের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই ধরনের লগ্নিতে ঝুঁকির ভাগ অপেক্ষাকৃত বেশি হলেও দীর্ঘ মেয়াদে সেই ঝুঁকিও কমে আসে। কিন্তু আপনার হাতে যদি সময় কম থাকে? তা হলে তো ঝুঁকি নেওয়াটাই তো বড় ঝুঁকি। সে ক্ষেত্রে সাবেক সঞ্চয় প্রকল্পগুলিতে বেশি টাকা রেখে পুঁজি সুরক্ষিত করা ছাড়া উপায় কম।
ঝুঁকির রুচি
শুধু অবশ্য সময় নয়। আপনি কোন খাতে লগ্নি করবেন, সেটা কিছুটা নির্ভর করে আপনার ঝুঁকি নিতে পারার মানসিকতার উপরেও। শেয়ার বাজারের সূচকের দোলাচল যদি আপনাকে বিচলিত করে, তা হলে তো আপনার পক্ষে ইকুইটি নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি করাই মুশকিল!
সে ক্ষেত্রে আপনার জন্য ব্যালান্সড ফান্ড বা ডেট ফান্ড রয়েছে। আর ফিক্সড ডিপোজিট, পিপিএফ, ডাকঘরের বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্প তো আছেই। কন্যা সন্তানের জন্য রয়েছে সুকন্যা সমৃদ্ধি প্রকল্প। অনেক দিন পরে সম্প্রতি এই প্রকল্পগুলিতে সুদের হার ৪০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে সাধারণ লগ্নিকারীদের মধ্যে এগুলির জনপ্রিয়তা আবারও বাড়বে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই প্রকল্পগুলিতে লগ্নি করে মূল্যবৃদ্ধির সূচককে পিছনে ফেলা একটু মুশকিল।
উল্টো দিকে, বাজারের চাপ নিতে পারলে লগ্নির রাস্তা যে অনেকটাই চওড়া, তা তো আগেই বলেছি।
পুঁজির চৌকিদার
মনে রাখতে হবে, আপনার পুঁজির চৌকিদার কিন্তু আপনিই। তাই লগ্নির জায়গাগুলির উপরে সব সময়ে কড়া নজর রাখতে হবে। কারণ, প্রতি বছর কিছু কিছু করে রিটার্ন আসা জরুরি। তবেই না বিন্দু বিন্দু পুঁজি দিয়ে সঞ্চয়ের সিন্ধু তৈরি হবে!
যদি মনে করেন কোনও ফান্ড প্রত্যাশিত রিটার্ন দিচ্ছে না, তা হলে সেখান থেকে লগ্নি সরিয়ে অন্য কোনও ফান্ডের কথা ভাবতে হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে আবার পড়তি বাজারে বাড়তি পুঁজি ঢাললে পরে লাভের খাতা মোটা হয়।
করের ধাঁধা
ধরা যাক সন্তানের পড়াশোনার খরচের জন্য আপনি ধ্রুপদি কোনও সঞ্চয় প্রকল্পে লগ্নি করছেন। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে কিন্তু মুনাফার অংশকে আপনার উপার্জন হিসেবে ধরা হবে। আয়ের মধ্যে সেটিকেও হিসেব করে আয়কর জমা দিতে হবে আপনাকে। সে ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া কিছুটা কঠিন হয়ে যেতে পারে।
আবার আপনি যদি ইকুইটি নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ড বা ব্যালান্সড ফান্ডে লগ্নি করেন, তা হলে দীর্ঘ মেয়াদি মূলধনী লাভের উপরে করের পরিমাণ তুলনায় কিছুটা কম হতেও পারে। যদিও পুরোটাই নির্ভর করছে আপনার রোজগার, লগ্নির অঙ্ক এবং লগ্নির ক্ষেত্রের উপরে।
খরচের খতিয়ান
সন্তান যখন উচ্চ শিক্ষা বা পেশাদারি পাঠ্যক্রমে ভর্তি হবে তখন কত টাকা থাকতে হবে আপনার ব্যাঙ্কে? নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব না হলেও আনুমানিক একটা হিসেব কষা নিশ্চয়ই সম্ভব। মোটামুটি ৭% হারে খরচ বাড়বে ধরে নিয়ে একটা হিসেবের তালিকা দেওয়া হল (পেশাদারি পাঠ্যক্রমের সম্ভাব্য খরচ)। মনে রাখতে হবে, এটা শুধুই টিউশন ফি। এর বাইরেও বই-খাতা, হস্টেল-সহ বিভিন্ন খাতে খরচ আরও অনেকটাই বাড়বে।
এ বার নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে এখনকার খরচ দেড়-দু’দশক পরে ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে ঠেকতে পারে। আপনার মাথায় প্রথমেই প্রশ্ন আসবে, এই খরচ তোলা কি সম্ভব? আমার আশ্বাস, পরিকল্পনামাফিক এগোলে অবশ্যই সম্ভব। তবে সঞ্চয় শুরু করতে হবে এখনই। এই মুহূর্তে। আর কোন ধরনের লগ্নি করলে নির্দিষ্ট সময় পরে সঞ্চয় কোন জায়গায় পৌঁছতে পারে সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকলে বাড়তি সুবিধা হয়।
লগ্নি কোথায়
এ বার লগ্নির ক্ষেত্রগুলি নিয়ে খানিক আলোচনা করা যাক।
মিউচুয়াল ফান্ড: এটি এমন একটি লগ্নি ক্ষেত্র যেখানে সব ধরনের মানুষের লগ্নির সুযোগ রয়েছে। যাঁরা ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন তাঁদের জন্য তো বটেই, যাঁরা কম ঝুঁকি নিয়ে গড়পড়তা রিটার্ন পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চান তাঁদের জন্যও রয়েছে যথেষ্ট সুযোগ। আর ভাল কয়েকটি ফান্ড বেছে দীর্ঘ দিন ধরে লগ্নি করলে আপনার মুখের হাসি চওড়া হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অতীতের অভিজ্ঞতা অন্তত তা-ই বলে।
আপনার সন্তানের বয়স যদি ১০ বছরের কম হয় তা হলে তার উচ্চ শিক্ষার আঙিনায় পা রাখতে এখনও অনেক দেরি আছে। আমার মনে হয়, সে ক্ষেত্রে আপনার সামনে ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগও অনেক বেশি। কারণ, আপনার হাতে এখনও যথেষ্ট সময়। আর এই গোটা সময়টা জুড়ে ইকুইটি ফান্ডে লগ্নি করলে বড় অঙ্কের রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই বেশি। এসআইপি-তে অল্প অল্প করে বহু বছর লগ্নি করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। এসআইপি-র বড় সুবিধা হল, লগ্নিকারীর সুবিধা অনুযায়ী সপ্তাহ, মাস বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে টাকা জমানো যায়। আবার ইএলএসএস প্রকল্পে টাকা রাখলে কর ছাড়ের সুবিধাও মেলে।
হাতে সময় কম থাকলে রিটার্ন ও পুঁজির নিরাপত্তা, দু’দিকই সামলাতে হবে আপনাকে। সে ক্ষেত্রে ব্যালান্সড ফান্ডে লগ্নির কথা ভাবা যেতে পারে। এই ধরনের ফান্ডে ৬৫-৭০% পুঁজি ইকুইটিতে এবং বাকি অংশটা বিভিন্ন ঋণপত্রে লগ্নি করা হয়।
ইকুইটি ফান্ডে দীর্ঘ দিন ধরে লগ্নি করলে কী ধরনের রিটার্ন প্রত্যাশা করতে পারেন আপনি, তার একটা কাল্পনিক ছবি এ বার আঁকা যাক। ধরা যাক আপনি মাসে ১০,০০০ টাকা করে লগ্নি করছেন। বিভিন্ন মেয়াদে আপনার সঞ্চয়ের বহর কী হতে পারে, তা উপরের ছকে দেওয়া হল।
দীর্ঘ মেয়াদে লগ্নি করলে এসআইপি-তে ১০% রিটার্ন কিন্তু বিরাট কোনও ব্যাপার নয়। বাজার স্বাভাবিক আচরণ করলে এর বেশিই রিটার্ন পেতে পারেন আপনি।
হয়তো ভাবছেন, ঝুঁকি কি নেই? এই মুহূর্তটাই যেমন শেয়ার বাজারের পক্ষে ভাল সময় নয়। গত কয়েক দিনে অনেকটাই পড়েছে সূচক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শেয়ার বাজারের এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম নয়। অতীতেও একাধিক বার বন্ধুর পথ পার হতে হয়েছে বাজারকে। কিন্তু সেই সঙ্কট চিরস্থায়ী হয়নি। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাজার।
সাবেকি লগ্নি: ঝুঁকির পথে হাঁটতে না চাইলে পিপিএফে লগ্নি আপনার পক্ষে ভাল। এটি ১৫ বছরের প্রকল্প। বছরে সর্বোচ্চ দেড় লক্ষ টাকা রাখা যায়। প্রকল্প শেষ হওয়ার পরে ৫ বছর করে মেয়াদ বাড়ানো যায়। আবার ৭ বছর পর থেকে পুঁজির একাংশ তোলাও যায়। তবে এই প্রকল্পে লগ্নি করার আগে একটা জিনিস মাথায় ঢুকিয়ে ফেলতে হবে। আপনি সন্তানের পড়াশোনার জন্য টাকা জমাচ্ছেন। তাই পিপিএফের লগ্নি করতে হবে সময় হিসেব করে। এমন পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয় যে, আপনার টাকা দরকার, কিন্তু মেয়াদ শেষ না হওয়ার জন্য সেই টাকা আপনি তুলতে পারছেন না।
ঝুঁকির ফসল: বছরে দেড় লক্ষ টাকা করে পিপিএফে জমালে আপনার সঞ্চয়ের অঙ্ক দাঁড়াবে আনুমানিক ৪২.৪৮ লক্ষ টাকা। অন্য দিকে, একটু ঝুঁকি নিয়ে ওই একই পরিমাণ লগ্নি (মাসে ১২,৫০০ টাকা) যদি আপনি ইকুইটি ফান্ডে করেন, তা হলে বছরে ১৫% রিটার্নের হিসেবে আপনার সঞ্চয়ের ভাঁড়ারে জমতে পারে ৮৪.৬১ লক্ষ টাকা। পার্থক্যটা কিন্তু কম নয়।
সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা: কন্যাসন্তানের জন্যই এই লগ্নি। এর বৈশিষ্ট হল, মেয়ের ২১ বছর বয়সে যখন প্রকল্পটি ম্যাচিওর করবে তখন সেই সঞ্চয় তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেই জমা পড়বে। বছরে দেড় লক্ষ টাকা করে রাখলে ২১ বছর পরে সঞ্চয়ের অঙ্ক হতে পারে ৭৯ লক্ষ টাকা।
জীবন বিমা: সন্তানের পড়াশোনার খরচের সঙ্গে সরাসরি এর যোগ নেই। কিন্তু জীবন বিমা যে কোনও পরিবারের কাছে একটা ঢালের মতো। মনে রাখতে হবে, বহু চেষ্টার পরেও অনেক ভাল-মন্দই আমাদের হাতে থাকে না। এটাই কঠোর বাস্তব। কিন্তু পরিবারের সদস্যেরা যাতে আতান্তরে না পড়েন, তার জন্য জীবন বিমা করিয়ে রাখতেই হবে রোজগেরে সদস্যকে। কারণ, অকালে তাঁর মৃত্যু হলে পরিবারের সদস্যদের বহু কৃচ্ছ্রসাধন তো করতে হবেই, অনিশ্চিত হয়ে পড়বে সন্তানের পড়াশোনাও। তাই ভালবাসার মানুষদের জন্য যথেষ্ট অঙ্কের টার্ম প্ল্যানে লগ্নি করে রাখতেই হবে সেই রোজগেরে সদস্যকে।
যে কোনও মা-বাবাই সন্তানের কাছ থেকে তার সেরাটা চান। সন্তানের উপরে সেই প্রত্যাশার চাপ কম থাকে না। কিন্তু সেই একই চাপ তো মা-বাবাকেও নিতে হবে! সন্তানের কাছ থেকে সেরাটা বার করে আনার পুঁজির জোগানটা তো তাঁদেরই দিতে হবে। তাই সেই পুঁজি সংগ্রহের কাজটা শুরু হোক আজ থেকেই।
লেখক: বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy