অবশেষে কপাল ফেরার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে দেশের বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পের। তথ্য-পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালে নানা প্রকল্পে ২৫,৬৮০ কোটি টাকার পুঁজি ঢেলেছে বেসরকারি বিনিয়োগ সংস্থাগুলি (প্রাইভেট ইকুইটি)। যারা শেয়ারের বিনিময়ে বিভিন্ন সংস্থার প্রকল্পে লগ্নি করে। ২০১৪ সালের তুলনায় ওই সংখ্যা ৭২% বেশি। কিন্তু তার ছিটেফোঁটাও পায়নি এ রাজ্য। জমি জটিলতার আশঙ্কায় এখানে নির্মাণ শিল্পে লগ্নি করা থেকে সাত হাত দূরেই থাকছে দেশি-বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ সংস্থা।
বিশেষজ্ঞ সংস্থা কুশম্যান অ্যান্ড ওয়েকফিল্ডস-এর দাবি, ২০০৮ সালের পরে এই প্রথম এত বড় মাপের বিনিয়োগ পেল দেশের নির্মাণ শিল্প। কপাল ফেরার এই দিনে লাভবান হয়েছে মুম্বই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই ও হায়দরাবাদ। কিন্তু কলকাতা সেই তিমিরেই। আবাসন বা অফিস তৈরির জায়গা— কোন ক্ষেত্রেই এই বিনিয়োগে ভাগ বসাতে পারেনি এ শহর। নির্মাণ শিল্পমহল বলছে, জমি নিয়ে অনিশ্চয়তাই এর জন্য দায়ী। যে কারণে এ রাজ্যের কোথাও কোনও প্রকল্পে পুঁজি ঢালতে আগ্রহ দেখায়নি দেশি-বিদেশি বড় বিনিয়োগ সংস্থাগুলি। যেমন, নির্মাণ শিল্পের সংস্থাগুলির সংগঠন ক্রেডাইয়ের এক কর্তা বলেন, ‘‘এখানে একলপ্তে বড় জমি মেলা ভার। টুকরো টুকরো জমির একাধিক মালিক থাকায় সমস্যা আরও বেড়ে যায়। জমি জটের আশঙ্কায় এগোতে চায়নি বেসরকারি বিনিয়োগ সংস্থাগুলি।’’ সকলেরই মত, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ সংস্থাগুলি এ ধরনের জটিলতা এড়িয়ে চলাই পছন্দ করে।
কলকাতা নিয়ে বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলির অনীহা স্পষ্ট করেছে কুশম্যানের রিপোর্ট। সেখানে প্রকাশ, ২০১৫ সালে ভারতে প্রাইভেট ইকুইটি বা শেয়ারের বিনিময়ে বিনিয়োগ করে এমন ৯০টি সংস্থা পুঁজি ঢেলেছে। ২০১৪ সালে যে সংখ্যা ছিল ৭৫। মোট লগ্নির ৩৪% দখল করেছে মুম্বই, দিল্লি ২৩% ও বেঙ্গালুরু ১৬.৭%। মুম্বই পেয়েছে ৮৮৩০ কোটি টাকা। দিল্লি ও বেঙ্গালুরু পেয়েছে যথাক্রমে ৫৮৮০ ও ৪২৮০ কোটি। পুণের মতো ছোট শহরও পেয়েছে ৭২০ কোটি। কিন্তু কলকাতার ভাঁড়ার শূন্য।
এ রাজ্যে শহরাঞ্চলে জমির ঊর্দ্ধসীমা আইনই এতদিন বড় বাধা ছিল বলে জানান ক্রেডাইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট হর্ষবর্ধন পাটোডিয়া। তিনি বলেন, ‘‘বড় নির্মাণ প্রকল্প তৈরির ক্ষেত্রে এই নিয়ম সমস্যা হয়ে দাঁড়াত। তবে রাজ্য সরকারের নতুন টাউনশিপ পলিসি এই ছবিটা বদলে দেবে।’’ প্রসঙ্গত উপনগরী গড়ার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার জমির ঊর্দ্ধসীমা আইনে ছাড় দিয়েছে। নতুন নীতির টানে বিনিয়োগকারীরা প্রাথমিক ভাবে আগ্রহ দেখালেও বাস্তবে তা এখনও কার্যকর হয়নি।
তবে শুধুই জমির সমস্যা নয়। রাজ্যের সার্বিক অর্থনীতিকেও দায়ী করেছে সংশ্লিষ্ট মহল। বাজার চাঙ্গা না হলে লগ্নিকারীরা টাকা ঢালার আগ্রহ দেখাবে না বলেই মনে করছে তারা। আবাসন ও অফিসের জায়গা বিক্রির সঙ্গে সরাসরি রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতির যোগাযোগ রয়েছে বলে মনে করে বিশেষজ্ঞ সংস্থা নাইট ফ্র্যাঙ্ক। তাদের মতে, আর্থিক উন্নয়নের অভাবেই ক্রেতায় টান পড়ছে। নাইট ফ্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ স্যমন্তক দাস বলেন, ‘‘কর্মসংস্থান হলে ক্রেতার সংখ্যাও বাড়বে। নচেৎ নয়।’’
অফিস ও আবাসন, দু’টি ক্ষেত্রেই এ রাজ্যে চাহিদা কমছে। বিশেষজ্ঞ সংস্থা কুশম্যান অ্যান্ড ওয়েকফিল্ডের হিসেব বলছে, ৩৩.২% অফিসের জায়গা খালি পড়ে। কোনও ক্রেতা নেই। একই ভাবে আবাসনের ক্ষেত্রেও ৩০% কমেছে চাহিদা। চাহিদা ও সরবরাহের এই অসামঞ্জস্যই বিনিয়োগের পথে অন্যতম বাধা হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে নির্মাণ শিল্পে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু নিয়মকানুন বদলেছে মোদী সরকার। শিথিল করা হয়েছে কিছু শর্ত। যেমন, বিনিয়োগের তিন বছর পরে প্রকল্প শেষ না হলেও তা থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে লগ্নিকারী। তুলে নিতে পারবে পুঁজি। ২০ হাজার বর্গফুটের কম প্রকল্পেও বিদেশি বিনিয়োগ ঢালা যাবে। আগে প্রকল্পের ন্যূনতম মাপ ছিল ২০ হাজার বর্গফুট। আর এই নতুন ছাড়ের টানেই মূলত বিদেশি প্রাইভেট ইকুইটির হাত ধরে লগ্নি পরিমাণ এক লাফে ৭২% বেড়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট মহলের। গোল্ডম্যান স্যাকস, ব্ল্যাকস্টোন ও ওয়ারবার্গ পিঙ্কাসের মতো সংস্থা সেই টানেই ঝাঁপিয়েছে। যার বিন্দুমাত্র জোটেনি এ রাজ্যের ভাগ্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy