Advertisement
০৭ মে ২০২৪

ভিক্ষাও ই-ওয়ালেটে, ভিখারির গলায় ঝুলছে পেটিএম বোর্ড!

শেষমেশ ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র চমকে দেওয়া বিজ্ঞাপনের খোঁজ মিলল বালিগঞ্জ নিউ মার্কেটের সামনে! শিবু ঘোষ।জন্ম থেকে অন্ধ। উস্কোখুস্কো চুল। রোগা চেহারা। বয়স বছর বাইশ। দিন চলে ভিক্ষাবৃত্তি করে। তার জন্য হাতে বাটি আর গলায় পেটিএম!

শিবু ঘোষ। ছবি: নিজস্ব চিত্র

শিবু ঘোষ। ছবি: নিজস্ব চিত্র

গার্গী গুহঠাকুরতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:৪৮
Share: Save:

শেষমেশ ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র চমকে দেওয়া বিজ্ঞাপনের খোঁজ মিলল বালিগঞ্জ নিউ মার্কেটের সামনে!

শিবু ঘোষ।

জন্ম থেকে অন্ধ। উস্কোখুস্কো চুল। রোগা চেহারা। বয়স বছর বাইশ। দিন চলে ভিক্ষাবৃত্তি করে। তার জন্য হাতে বাটি আর গলায় পেটিএম!

কাছে যেতেই দেখা গেল, নীল সুতো দিয়ে গলা থেকে ঝোলানো নীল-সাদা বোর্ডে লেখা— ‘পেটিএম অ্যাক্সেপ্টেড হিয়ার।’ অর্থাৎ, নগদের বদলে ওই ই-ওয়ালেটে ভিক্ষা দিলেও চলবে।

৮ নভেম্বর নোট বাতিলের পর থেকে ই-ওয়ালেট যে প্রায় সর্বত্র সেঁধিয়ে যাচ্ছে, তার ছবি কাগজে-টিভিতে দেখা যাচ্ছে প্রায়ই। মাছের বাজার, কাঁকড়া বিক্রেতা থেকে শুরু করে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে চায়ের দোকান। গত দু’মাসে পেটিএমের মতো ই-ওয়ালেট ঢুকে পড়ছে প্রায় সর্বত্র। উনুন, কেটলি আর খানকয় গ্লাস ছাড়া রাস্তার ধারের যে চায়ের গুমটিতে আর কিচ্ছুটি নেই, ই-ওয়ালেট ‘হানা দিয়েছে’ সেখানেও।

কিন্তু তা বলে ভিক্ষা? তা-ও আবার সেই পরিষেবা ব্যবহার করছেন এমন এক জন, জন্ম থেকে যাঁর কি না দৃষ্টিশক্তিই নেই? নোটকে পাশে সরিয়ে রেখে নেট মারফত ডিজিটাল লেনদেনকে আঁকড়ে ধরার যে কথা দিল্লি লাগাতার বলে চলেছে, এর থেকে পোক্ত বিজ্ঞাপন তার জন্য খুঁজে পাওয়া সত্যিই বেশ শক্ত।

ময়লাটে সাদা শার্ট পরা শিবুর কাছে প্রথম জিজ্ঞাসাই ছিল, হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন? নোট নাকচের চক্করে? অনেক সময়ে যে-শহরের রাস্তার পাশে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া কারও দিকে ফিরে তাকাতেও সময় হয় না, সেখানে ধৈর্য ধরে ই-ওয়ালেটে ভিক্ষে দেবেন ক’জন?

চায়ের দোকান। ছবি:নিজস্ব চিত্র

শিবুবাবু বলছিলেন, ‘‘গোড়ায় নোট সঙ্কটে ভিক্ষা তলানিতে ঠেকেছিল। ঝুলি ভরছিল না শনি-মঙ্গলবারেও। হয়তো হাতের খুচরো খরচ করতে ভরসা পাচ্ছিলেন না অনেকে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি শুধরেছে। তবু পেটিএম নেওয়া আসলে ভবিষ্যতের কথা ভেবে!’’ এখনও নিজের মোবাইল নেই। খোলা হয়নি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। তা সত্ত্বেও ই-ওয়ালেটের দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছেন কয়েক জন বন্ধুর পরামর্শে ও সহযোগিতায়। পেটিএমের টাকা নগদে ভাঙিয়েও দিয়েছেন তাঁরা।

শিবুবাবু বলেন, ‘‘বন্ধুরা সব করে দিয়েছে। এখন এতে রোজগারও তেমন বেশি নয়। প্রথম চার দিনে ৬০ টাকা। কিন্তু কেন জানি না মনে হল, ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। ওটাই ভবিষ্যৎ।’’ সেই কারণেই এ বার দ্রুত নিজের পেটিএম অ্যাকাউন্ট খুলতে চান তিনি। তার জন্য আধার নম্বর জোগাড় করে আগে খুলতে চান জন-ধন অ্যাকাউন্টও।

বাঁকুড়ার ওন্দা ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা কল্প ঘোষ ও সাবিত্রী ঘোষ। শিবুবাবুর বাবা-মা। বছরে দু’বার বাবা, মা, দিদি ও ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যান। বাকি সময়ের ঠিকানা গড়িয়াহাট উড়ালপুলের তলা। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ব্লাইন্ড স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। প্রশিক্ষণ নেন কৃষিকাজেরও। কিন্তু গ্রামে ফিরে চাষবাসে সুবিধা তেমন হয়নি। তাই পেটের জোগাড়ের খোঁজে শহরে ফেরা। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা।

জন্ম থেকেই চোখে দেখার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ভিক্ষার বাটি ধরতে হয়েছে পেট চালাতে। তা সত্ত্বেও প্রতি মুহূর্তে নতুন কিছু শিখে চলার ইচ্ছে হারাননি। ফেসবুক-সহ সোশ্যাল মিডিয়ার পুরোদস্তুর খবর রাখেন। গড়গড় করে হিন্দি-ইংরেজিতে নকল করতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। হাসিমুখে সকলের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলতে পারেন চটপট।

সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ঠেলে ডিজিটাল প্রযুক্তিকে আঁকড়ে ধরার কথা মোদী বলেন। শিবুবাবুকে দেখে মনে হল, তিনি তার জ্বলন্ত বিজ্ঞাপন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

digital wallet beggar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE