Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আইন-আদালত

বাড়ি বাবা ও কাকার নামে। কাকার ছেলে রয়েছে। এখন আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে বাড়িটি দু’ভাগে ভাগ করতে চাই। কিন্তু সেটি এমন ভাবে তৈরি যে, সম্পূর্ণ বাসযোগ্য অবস্থায় তা আলাদা করা যাবে না। এই অবস্থায় আমরা চাই বাড়িটি প্রোমোটারের হাতে তুলে দিতে।

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৬
Share: Save:

বাড়ি বাবা ও কাকার নামে। কাকার ছেলে রয়েছে। এখন আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে বাড়িটি দু’ভাগে ভাগ করতে চাই। কিন্তু সেটি এমন ভাবে তৈরি যে, সম্পূর্ণ বাসযোগ্য অবস্থায় তা আলাদা করা যাবে না। এই অবস্থায় আমরা চাই বাড়িটি প্রোমোটারের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু কথাবার্তা যখন চলছে, তার মধ্যেই জানতে পারি বাড়ির মূল দলিল হারিয়ে গিয়েছে। থানায় জেনারেল ডায়েরি করার পরে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে সার্টিফায়েড কপি তোলার চেষ্টা করলেও তা পাইনি। শুধু ব্লক ল্যান্ড অ্যান্ড ল্যান্ড রেভিনিউ অফিসারের সই করা ইনফর্মেশন স্লিপ পেয়েছি। এই কাগজ দেখেই প্রোমোটার কাজ শুরু করতে চাইছেন। বাবা ও কাকাকে বলছেন, আমার এবং খুড়তুতো ভাইয়ের নামে বাড়িটি দানপত্র করে দিতে। মানিয়ে নিতে বলছে উকিলও। আমাদের কাছে পুরসভার কর এবং খাজনার সমস্ত রসিদ রয়েছে। আমার প্রশ্ন—

১) আদালতের সাহায্যে হারানো দলিলের সার্টিফায়েড কপি বার করা কি খুব খরচসাপেক্ষ এবং দীর্ঘ মেয়াদি পদ্ধতি?

২) প্রোমোটার বাড়িটি দানপত্র করাতে চাইছেন কেন?

৩) শুধু ইনফর্মেশন স্লিপের উপর ভিত্তি করে কি দানপত্র করা যায়? তা করলেও কি পুরোপুরি বৈধ হবে?

৪) দানপত্র করার পরে যে মালিকানা বদল হচ্ছে, তার ফলে নতুন ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি বাবদ অতিরিক্ত খরচ হবে কি?

৫) ইনফর্মেশন স্লিপই যদি এই কাজের জন্য যথেষ্ট হয়, তা হলে দলিল রাখার প্রয়োজন কী?

৬) উকিল যে মানিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন, তা কী রকম?

৭) মানিয়ে নিলে কি আমরা পরবর্তী কালে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে গেলে অসুবিধার মুখে পড়তে পারি?

৮) দলিলে নির্দিষ্ট সম্পত্তির আগের মালিকানা-সহ বিভিন্ন তথ্য থাকে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে দলিল হারিয়ে যাওয়ায় সেই তথ্য থাকবে না, এতে কি কোনও অসুবিধা হবে?

৯) প্রোমোটারের সঙ্গে যে কথা হয়েছে, তাতে আমাদের ভাগের ফ্ল্যাটগুলি আমরাই বেচতে পারব। সে ক্ষেত্রে কি আয়কর দিতে হবে?

সুগত চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা

১) হারানো দলিলের সার্টিফায়েড কপি বার করা একটু সময়সাপেক্ষ হতে পারে। কিন্তু খুব খরচের ব্যাপার বলে মনে হয় না। আপনাদের এলাকার রেজিস্ট্রি অফিসে বাড়ির ঠিকানা, জে এল নং, মৌজা ইত্যাদি দিয়ে দলিলের সার্টিফায়েড কপির জন্য আবেদন করুন। জে এল নং, তৌজি নং, মৌজা ইত্যাদি জানা না থাকলে কবে বাড়ি কিনেছিলেন বা যে উপায়ে বাড়ি বাবা-কাকার নামে হয়েছিল, সেই সাল বার করুন। সে ক্ষেত্রে সাল ধরে খুঁজলেও দলিলের সার্টিফায়েড কপি বার করা যায়।

শুধু আপনার এলাকার রেজিস্ট্রি অফিসই নয়, রেজিস্ট্রার অব অ্যাশিওরেন্স-এর অফিস থেকেও জমি-বাড়ির দলিলের সার্টিফায়েড কপি বের করা যায়। আজকাল এই প্রাচীন নথিগুলি সংরক্ষণ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণও হয়েছে। আপনারা ল্যান্ড অ্যান্ড ল্যান্ড রেভিনিউ অফিসে গিয়ে পৈতৃক বাড়ি সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য নিশ্চয়ই পেয়েছেন। এ বারে ওই তথ্য সংবলিত একটি আবেদনপত্র (দলিলের সার্টিফায়েড কপি চেয়ে) রেজিস্ট্রি অফিসে বা রেজিস্ট্রার অব অ্যাশিওরেন্স-এর অফিসে জমা দিন। নিশ্চয়ই বাড়ির হারিয়ে যাওয়া দলিলের সার্টিফায়েড কপি পাবেন।

২) প্রোমোটার কেন বাবা ও কাকাকে দিয়ে বাড়ি আপনার ও খুড়তুতো ভাইয়ের নামে দানপত্র করাতে চাইছেন, সেটা তিনিই ভাল বলতে পারবেন। তাঁর থেকে ভাল করে বুঝে নিন ব্যাপারটি। তবে আপাতদৃষ্টিতে এর কোনও কারণ আমার নজরে পড়ছে না। যদি পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরির জন্য উনি বাবা-কাকার কাছ থেকে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ বা ‘আম মোক্তারনামা’ নিতে চাইতেন, তা হলেও বুঝতাম যে, তিনি চান ওই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিষয়গুলিতে যাতে তাঁদের বারবার বিরক্ত করতে না হয়। অনেক সময়ে বাবা-কাকাদের একাধিক সন্তান থাকলে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু একমাত্র সন্তান হওয়ায় সেই গণ্ডগোলের সম্ভাবনাও নেই। যদিও মায়েরা জীবিত আছেন এবং বাবা-কাকার অবর্তমানে তাঁরাও অর্ধেক অংশের উত্তরাধিকারী হবেন।

৩) শুধু ইনফর্মেশন স্লিপের উপরে ভিত্তি করে দানপত্র করা ঝুঁকির। মনে রাখবেন, দানপত্র ও যে কোনও দলিলেই জমির ইতিহাস লিখতে হয়। এ ক্ষেত্রে ওই বাড়িটি কী করে আপনার বাবা-কাকার মালিকানাধীনে এল সেটা, অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা থাকতে হবে। বাড়ির ঠিকানা-সহ খুঁটিনাটি বিষয় ও বৈশিষ্ট্যও বিশদে থাকা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে বাড়ির (যা পরে ফ্ল্যাট হতে যাচ্ছে এবং যেখানে আপনারাও ফ্ল্যাট পাবেন) যে কোনও রকম মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যা থেকে তা আপনাদের বাঁচাবে।

৪) দানপত্র না-হলে প্রোমোটারের সঙ্গে চুক্তি হবে বাবা ও কাকাকে মালিকপক্ষ ধরে। ফ্ল্যাট তৈরির পরে আপনাদের অংশের জন্য নির্ধারিত ফ্ল্যাটের মালিক হবেন তাঁরাই। আলাদা করে ওই ফ্ল্যাটের মালিকানা পেতে রেজিস্ট্রি করতে না-হলেও, যেহেতু ফ্ল্যাটের মালিক হচ্ছেন দু’জন, তাই পরে আপনাদের অংশ ‘পার্টিশন সুট’ বা ‘পার্টিশন মামলা’র মাধ্যমে মালিকানার ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। বাবা-কাকার অবর্তমানে এক অংশের ফ্ল্যাটের মালিকানা পাবেন আপনি ও আপনার মা। অপর অংশের কাকিমা ও খুড়তুতো ভাই।

আর আপনারা এখনই দানপত্র করে নিতে চাইলে বলব— প্রথমত, এখন সেটা করা কঠিন। কারণ দলিলটি হারিয়েছেন এবং তার সার্টিফায়েড কপিও নেই। দ্বিতীয়ত, কেন প্রোমোটাররা আপনাদের নামে দানপত্র করাতে চাইছেন, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। তৃতীয়ত, দানপত্র করা মানে বাবা-মা ও কাকা-কাকিমা জীবদ্দশাতেই তাঁদের ‘মাথা গোঁজার ঠাঁই ছেলেদের নামে করে দিচ্ছেন। কারণ দানপত্র করা মাত্রই কার্যকর হয়। এ রকম ক্ষেত্রে প্রবীণরা অনেক সময় অসহায়তায় ভুগতে থাকেন, যা সংসারে ডেকে আনতে পারে অশান্তি।

তবে যতটা বুঝছি, ওই বাড়িতে বাবা ও কাকার ‘আনডিভাইডেড’ এবং ‘আনডিমার্কড’ অর্ধাংশ রয়েছে। এখনই আগে ‘পার্টিশন’ করে বাবা-কাকার অর্ধাংশ নির্ধারণ করে দানপত্র করা সম্ভব। তবে শুধু ইনফর্মেশন স্লিপের উপর নির্ভর করে বাড়ির ভাগাভাগি বা দানপত্র ইত্যাদি করা হয়তো বা ঠিক হবে না। বা রেজিস্ট্রারও রেজিস্ট্রি করে দিতে রাজি হবেন না।

৫) না, আবারও বলছি ইনফর্মেশন স্লিপের উপর ভিত্তি করে বাড়ির মালিকানা নির্ধারণ, ভাগাভাগি করা কঠিন। এর পরে বাড়ির দানপত্র এবং তারও পরে বাড়ির মালিকপক্ষের সঙ্গে প্রোমোটারের চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করা সম্ভব না-ও হতে পারে। ফ্ল্যাটগুলির ভাবী মালিকদের সঙ্গে আপনাদের ও প্রোমোটারের মালিকানা সংক্রান্ত দলিল প্রস্তুত করা ইত্যাদি কাজও এতে কঠিন হয়ে যাবে। কাজেই দলিলের জায়গা বিএলঅ্যান্ডএলআরও থেকে পাওয়া ইনফর্মেশন স্লিপ নিতে পারে না।

৬) আইনজীবী কেন মানিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন, সেটা বুঝতে আপনারা তাঁর সঙ্গে বসে আলোচনা করুন। যে জায়গাগুলি বুঝতে পারছেন না, পরিষ্কার করুন। এই সব ক্ষেত্রে এমন গভীর গোপন কিছু থাকতে পারে না, যা বুঝতে পারবেন না। কোনও অবৈধ বা বেআইনি কিছুই হওয়া উচিত নয়, যা ভবিষ্যতে অসুবিধায় ফেলবে।

৭) এই অংশের প্রশ্নের উত্তর আমি আগেই দিয়ে দিয়েছি। ঠিকই বলেছেন। ফ্ল্যাট বা জমি, যে কোনও কিছুর বিক্রি সংক্রান্ত দলিলেই ওই সম্পত্তির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ও যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় থাকা উচিত। ভবিষ্যতে যাঁরা ওই ফ্ল্যাট কিনতে যাবেন, তাঁরা কিন্তু মূল দলিলের কপি দেখতে চাইবেন।

আপনার ৮ নম্বর প্রশ্নের উত্তরও এরই সঙ্গে আমি দিয়ে দিলাম।

৯) প্রোমোটারকে যদি তাঁর অংশের (প্রোমোটারস অ্যালোকেশন) সব ফ্ল্যাট বেচতে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি না-দেওয়া থাকে, তা হলে আপনাদের মাধ্যমেই প্রোমোটারের অংশের ফ্ল্যাটগুলি বিক্রি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রোমোটারের সঙ্গে চুক্তিতে লেখা থাকতে হবে যে, তাঁর অংশের ফ্ল্যাট বিক্রির টাকায় আপনাদের ভাগ নেই বা আপনাদের অ্যাকাউন্টে তা জমা হবে না। তা হলেই আয়কর দফতরের কাছে জবাবদিহি করতে হবে‌ না।

পরামর্শদাতা: আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

জমিই হোক বা সঞ্চয়। আপনার যে কোনও বিষয়-সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শের জন্য লিখুন। ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না। ‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১। ই-মেল: bishoy@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Law and order
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE