Advertisement
E-Paper

সাইরাস বিদায়ে অনিশ্চয়তা বাজারে

কর্পোরেট দুনিয়াকে চমকে দিয়ে টাটা গোষ্ঠীর শীর্ষ পদ থেকে সাইরাস মিস্ত্রিকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে মঙ্গলবার শেয়ার দর পড়ল তাদের সংস্থাগুলির। টাটা গোষ্ঠীর সংস্থাগুলি নিয়ে নিজেদের সংশয় এ দিন গ্রাহকদের জানিয়েছে বহুজাতিক আর্থিক সংস্থা সিটি গ্রুপ।

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:০৯

কর্পোরেট দুনিয়াকে চমকে দিয়ে টাটা গোষ্ঠীর শীর্ষ পদ থেকে সাইরাস মিস্ত্রিকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে মঙ্গলবার শেয়ার দর পড়ল তাদের সংস্থাগুলির।

টাটা গোষ্ঠীর সংস্থাগুলি নিয়ে নিজেদের সংশয় এ দিন গ্রাহকদের জানিয়েছে বহুজাতিক আর্থিক সংস্থা সিটি গ্রুপ। তারা বলেছে, ‘‘গত কয়েক বছরে সাইরাসের নেতৃত্বে ঋণ কমানোর পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করেছে টাটা গোষ্ঠী। জোর দিয়েছে মূলধনের সঠিক ব্যবহারে।’’ তাদের আশঙ্কা, আগামী দিনে সাইরাসের অনুপস্থিতিতে সেই ধারের বোঝা কমানোর গতি শ্লথ হবে। হোঁচট খেতে পারে মূলধন থেকে রিটার্নের হার বাড়ানোর চেষ্টা।

মার্কিন আর্থিক সংস্থাটির এই সংশয় যে সামগ্রিক ভাবে শেয়ার বাজারকেও কিছুটা আচ্ছন্ন করেছে, তার ইঙ্গিত অন্তত এ দিন টাটা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার দর পড়া থেকে স্পষ্ট। দাম কমেছে টাটা স্টিল (২.৫১%), টিসিএস (১.২%), টাটা মোটরস (১.০৭%), টাটা পাওয়ারের (১.৫%) মতো প্রধান সংস্থাগুলির শেয়ারের। পড়েছে টাটা কেমিক্যালস (২.০৯%), টাটা কফি (২.৬৩%), টাটা গ্লোবাল বেভারেজেস (২.৪৭%), টাটা কমিউনিকেশন্স (২.২৬%), ইন্ডিয়ান হোটেলস (৩.১৬%), টাইটান (১.১৯%), টাটা মেটালিক্স (৪.৯৭%)-সহ আরও বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার দরও। শেয়ার মূল্যের নিরিখে ১০,৭০০ কোটি টাকার সম্পদ মুছে গিয়েছে শুধু প্রধান সংস্থাগুলিরই। এই অনিশ্চিত বাজারে এ দিন সেনসেক্স নেমেছে ৮৭.৬৬ পয়েন্ট।

গ্রাহকদের পাঠানো নোটে ব্যাঙ্ক অব আমেরিকা-মেরিল লিঞ্চের বিশ্লেষক সঞ্জয় মুকিমেরও দাবি, টাটারা যে গোষ্ঠী পরিচালনার কৌশলে বদল চাইছে, সাইরাসকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। ওয়াকিবহাল মহলের কথায় ফুটে উঠছে সেই একই বিশ্লেষণ। তাঁদের মতে, সংস্থা পরিচালনার কৌশল এবং দর্শন— টাটাদের সঙ্গে এই দুই না মেলায় সরতে হল সাইরাসকে।

২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে রতন টাটার ২১ বছরের রাজ্যপাটে টাটা গোষ্ঠীর ব্যবসার অঙ্ক ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১০ হাজার কোটি ডলার (৬ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা) হয়েছে। কিন্তু তেমনই তাঁর জমানার শেষ ১০ বছরে ধার বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ। কারণ, ওই সময় টাটা গোষ্ঠীকে আক্ষরিক অর্থেই বহুজাতিক সংস্থা করে তুলতে একের পর এক বিদেশি সংস্থা কেনার পথে হেঁটেছেন রতন টাটা। ব্রিটিশ চা সংস্থা টেট্‌লি (২০০০), দেয়ু-র বাণিজ্যিক গাড়ি (২০০৪), সিঙ্গাপুরের ইস্পাত সংস্থা ন্যাটস্টিল (২০০৫), ১,২০০ কোটি ডলারে ইস্পাত বহুজাতিক কোরাস (২০০৭), ব্রিটিশ গাড়ি সংস্থা জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভার (২০০৮) ইত্যাদি। লাভ বা সাফল্যের মুখ দেখতে হিমসিম খেয়েছে অনেক দেশি উদ্যোগও। ন্যানো সফল হয়নি। মুনাফার মুখ দেখা কঠিন হয়েছে টাটা পাওয়ারের পক্ষে। সে ভাবে ডানা মেলেনি টেলি পরিষেবার ব্যবসাও। টাটাদের একশোর বেশি সংস্থার অনেকগুলির আর্থিক অবস্থাই তেমন পোক্ত নয়।

গত চার বছরে এই অবস্থা বদলাতে চেয়েছিলেন সাইরাস। জোর দিচ্ছিলেন দায় কমানোয়। যে কারণে লোকসানের বোঝায় ধুঁকতে থাকা টাটা স্টিলের ব্রিটিশ ব্যবসাকে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হননি। ১২০ কোটি ডলারে ওরিয়েন্ট-এক্সপ্রেস হোটেল চেন কেনার দৌড় থেকে পিছিয়ে এসেছেন। সরে এসেছেন ব্যাঙ্ক লাইসেন্সের দৌড় থেকেও। টাটা কেমিক্যালসের সার ব্যবসা বিক্রি করা হয়েছে। ভাবা হয়েছে টাটা পাওয়ারের ইন্দোনেশীয় কয়লা খনি বেচে দেওয়ার কথা। ঋণের বোঝা হাল্কা করতে না কি পরিকল্পনা ছিল ইন্ডিয়ান হোটেলস এবং টাটা কমিউনিকেশন্সের বিদেশি কিছু সম্পত্তি বিক্রিরও।

সেই সঙ্গে পরিচালন পদ্ধতির সম্ভবত বদল চাইছিলেন সাইরাস। একশোরও বেশি সংস্থায় সর্বত্র শুধু বিনিয়োগের জন্যই টাকা না ঢেলে জোর দিতে চেয়েছিলেন আগামী দিনের সম্ভাবনাময় ব্যবসায়। যেমন, ই-কমার্স সংস্থা টাটা ক্লিক, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণের ব্যবসা ইত্যাদি।

এমন নয় যে, রতন টাটা-সহ টাটা গোষ্ঠী মুনাফা, মূলধন থেকে ভাল হারে রিটার্ন, ধার কমানো কিংবা আগামী দিনের সম্ভাবনাময় ব্যবসায় লগ্নির বিরোধী। এ দিনও টাটা গোষ্ঠীর সংস্থাগুলির শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে টাটা বলেছেন, বাজারে এই মুহূর্তের প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে অবস্থান যাচাই করুক প্রতিটি সংস্থা। লক্ষ্য হোক, শেয়ারহোল্ডারদের ভাল রিটার্ন দেওয়ার বন্দোবস্ত। অর্থাৎ, মুনাফা বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছেন তিনিও। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে খবর, তা সত্ত্বেও সাইরাসের সিদ্ধান্তের সঙ্গে টাটাদের সংঘাত হচ্ছিল মূলত দু’টি জায়গায়। প্রথমত তারা মনে করছিল, অনেক ক্ষেত্রেই পর্ষদ কিংবা প্রধান শেয়ারহোল্ডারদের (টাটা ট্রাস্টস) কিছুটা অন্ধকারে রেখে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সাইরাস। যেমন, ওয়েলস্পান রিনিউয়েবলস্‌-এর সৌর বিদ্যুৎ ব্যবসা কেনার কথা তারা জেনেছে প্রায় শেষ মুহূর্তে। ব্রিটেনের ইস্পাত ব্যবসা বিক্রির বিষয়েও সে ভাবে প্রধান শোয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শ করেননি তিনি। একই রকম পরিস্থিতি ছিল টেলিকম ব্যবসায় টাটাদের সঙ্গে গাঁটছড়া ভেঙে যাওয়া জাপানি সংস্থা এনটিটি ডোকোমোর ছুঁড়ে দেওয়া আইনি চ্যালেঞ্জ সামলানোর ক্ষেত্রে। তা ছাড়া, ঘুরিয়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা পুরোদস্তুর না-করে যে ভাবে ব্রিটেনে ইস্পাত ব্যবসা বিক্রির পথে হাঁটা হয়েছে, তাতে টাটা গোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও ভাবমূর্তিতেও ধাক্কা লেগেছে বলে মনে হয়ে থাকতে পারে টাটা ট্রাস্টসের।

রতন টাটার ক্যারিশমা বরাবর চোখধাঁধানো। যিনি বোর্ডরুমের মতো যুদ্ধবিমানের ককপিটেও স্বচ্ছন্দ। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত কিছুটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন থেকে নেওয়া। যেমন, বৃষ্টিতে দু’চাকায় সওয়ার কাকভেজা পরিবারকে দেখে একলাখি ন্যানো। ওয়াকিবহাল মহলের অনেকে বলছেন, স্বভাবলাজুক সাইরাসের মধ্যে এই বড় স্বপ্ন দেখার গুণও সে ভাবে খুঁজে পায়নি টাটা গোষ্ঠী। তাঁর ‘হঠাৎ’ বিদায় না কি এই সমস্ত কারণেই।

Cyrus Mistry Ratan Tata Market
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy