অরুণ জেটলি। সোমবার। ছবি: পিটিআই
দেশে কল-কারখানায় উৎপাদনের চাকা ঢিমে তালে ঘোরার জন্য এ বার সরাসরি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। শীর্ষ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজনের ঋণনীতিকে সরাসরি আক্রমণ করে তাঁর দাবি, উৎপাদন শিল্প ঝিমিয়ে পড়ার পিছনে ‘একমাত্র’ কারণ চড়া সুদের হার।
বর্ষবরণের মুখে উৎপাদন শিল্পকে চাঙ্গা করতে সোমবার প্রায় সান্তা ক্লজ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জেটলি। নরেন্দ্র মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান সফল করতে ডাক দিয়েছেন বিনিয়োগের পথে যাবতীয় বাধা সরানোর। কথা দিয়েছেন, আগামী দিনে শিল্পের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে আরও স্থিতি আনা হবে কর-নীতিতে। এবং তখনই উৎপাদন শিল্পের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে আক্রমণ করেছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে। এমনকী ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্যও রঘুরাম রাজনকে বিঁধেছেন তিনি।
উৎপাদন শিল্পকে চাঙ্গা করতে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প রূপায়ণের লক্ষ্যে এ দিন কর্মশালার আয়োজন করেছিল কেন্দ্র। সেখানেই অর্থমন্ত্রী বলেন, “গত কয়েক মাস বা বছরে উৎপাদন শিল্প মুষড়ে থাকার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পুঁজি সংগ্রহের চড়া খরচ। ঋণ নেওয়ার গতি বেশ ঢিমে। দ্রুত তৈরি হচ্ছে না পরিকাঠামোও।”
জেটলির যুক্তি, “চাইলে শিল্প যাতে মূলধন পায়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। বিশেষত যে-সমস্ত শিল্প লগ্নির অভাবে ধুঁকছে, তাদের যাতে মূলধনের অভাবে ধুঁকতে না-হয়, সে বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি।” চলতি সপ্তাহেই দেশের ব্যাঙ্কিং শিল্পের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন প্রধানমন্ত্রী। শিল্পের জন্য পর্যাপ্ত পুঁজির ব্যবস্থা করতে ওই বৈঠক কার্যকরী হবে বলেই জেটলির আশা।
সরাসরি রাজনের নাম না-করলেও, অর্থমন্ত্রীর এ দিনের আক্রমণের লক্ষ্য আসলে তিনিই বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ, বৃদ্ধির চাকায় গতি ফেরানোর লক্ষ্যে উৎপাদন শিল্পকে চাঙ্গা করতে সুদ কমানোর জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে বারবার আবেদন জানিয়েছেন জেটলি। ওই একই দাবি ক্রমাগত জানিয়ে চলেছে শিল্পমহলও। কিন্তু রাজন প্রায় প্রতি বারই স্পষ্ট জানিয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধির হার এখন কমেছে ঠিকই। কিন্তু চড়া মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি নির্মূল না-হওয়া পর্যন্ত সুদ ছাঁটাইয়ের রাস্তায় হাঁটবেন না তিনি।
সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, সুদ নিয়ে রাজনের একবগ্গা অবস্থানকেই এ দিন বিঁধেছেন অর্থমন্ত্রী। অভিযোগ করেছেন, কল-কারখানার চাকা দ্রুত ঘোরা আটকে রয়েছে শুধুমাত্র চড়া সুদের জাঁতাকলে।
তবে শিল্পপতিরা অবশ্য বারবারই বলেছেন, সুদ কমা জরুরি ঠিকই। তবে শুধু তাতে চিঁড়ে ভিজবে না। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে রাজনৈতিক বাধা সামলে সংস্কারের রথ ছোটাতে হবে সরকারকে। কাটাতে হবে জমি-জট। কর-নীতি নিয়েও শিল্পমহলের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে মোদী-সরকারকে। শুধু তা-ই নয়। কেন্দ্রের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনও বলেছেন, দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে এই মুহূর্তে জরুরি চাহিদাকে চাঙ্গা করা। সে জন্য প্রয়োজনে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পক্ষেও সওয়াল করেছেন তিনি।
চড়া সুদ নিয়ে বলার পাশাপাশি এ দিন অবশ্য সেই সব বিষয়ও ছুঁয়ে গিয়েছেন জেটলি। বলেছেন, “উৎপাদন শিল্পে পা রাখার পদ্ধতি আরও সহজ করা জরুরি। ওই ক্ষেত্রে যাবতীয় বাধা কমাতে হবে। বলা ভাল, সরিয়ে দিতে হবে। দরজা বন্ধ রাখলে লগ্নি আসা অসম্ভব।”
মোদীর স্বপ্নের প্রকল্প ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নিয়ে রাজন যে-প্রশ্ন তুলেছিলেন, এ দিন তা-ও উড়িয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। শীর্ষ ব্যাঙ্কের গর্ভনর বলেছিলেন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বা ভারতে তৈরি করা নয়। কেন্দ্রের জোর দেওয়া উচিত ‘মেক ফর ইন্ডিয়া’ বা ভারতের বাজারের জন্য তৈরি করার উপর। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে এ দিন জেটলির জবাব, “মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পে তৈরি কারখানা ভারতের ক্রেতাদের জন্য পণ্য তৈরি করবে না কি রফতানি বাজারের জন্য, সেই প্রশ্ন অবান্তর। আসল কথা হল সস্তায় ভাল গুণমানের পণ্য তৈরি করা। যাতে সর্বত্র তার কদর থাকে।”
এ মাসের গোড়ায় ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান সম্পর্কে সতর্ক করে রাজন বলেছিলেন, চিন ওই পথে হেঁটে হয়তো বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু আগাগোড়া রফতানি-নির্ভর ওই শিল্পনীতি ভারতের মতো উন্নয়নশীল, সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের দেশের পক্ষে কতটা ভাল হবে, তা নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন। বরং তাঁর মতে, এখানে কল-কারখানা তৈরিতে উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে পাখির চোখ হওয়া উচিত ভারতের বাজার। তা ছাড়া, শুধু উৎপাদন শিল্পে জোর দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
কিন্তু এ দিন অর্থমন্ত্রীর যুক্তি, আজকের হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতার বাজারে সারা বিশ্বেই ক্রেতারা খোঁজেন সেই সব পণ্য, যার গুণমান ভাল কিন্তু দাম কম। পরিষেবার ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। তাই সস্তায় ভাল পণ্য তৈরির লড়াইয়ে এঁটে উঠতে না পারলে, ভারত চিরকাল শুধু বাণিজ্যের দেশই থেকে যাবে। পণ্য উৎপাদনের দেশ হয়ে ওঠা আর কোনও দিনই তার হবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার গড়ার ছ’মাস পরেও সংস্কার তথা শিল্পের চাকায় গতি না-ফেরায় শিল্পমহল যে ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে, তা বিলক্ষণ বুঝছেন মোদী-জেটলি। যে কারণে বারবার শিল্পমহলকে তাঁরা বার্তা দিতে চাইছেন যে, সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার অটল। অন্তত সে বিষয়ে কোনও রাজনৈতিক বাধার সামনে তাঁরা মাথা নোয়াবেন না। বিমায় বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো, কয়লা খনি নিলাম ও জমি-বিল নিয়ে অর্ডিন্যান্স জারি করেছে কেন্দ্র। সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিকিৎসা-যন্ত্রাংশ তৈরির ক্ষেত্রে ১০০% বিদেশি লগ্নিকে ছাড়পত্র দেওয়ার। সেই সঙ্গে চড়া সুদ যাতে শিল্প গড়ার পথে বাধা হয়ে না-দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করতে এখন শীর্ষ ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে তোপ দাগতেও পিছপা হচ্ছেন না জেটলি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy