কোমর পর্যন্ত ঘন কালো চুল ছিল। মোটা বিনুনি দেখে কত জনে যে প্রশংসা করতেন! আমিও সেই সব মন্তব্য বেশ উপভোগ করতাম। কেমোথেরাপি শুরু হওয়ার পরে সেই চুল যখন উঠতে লাগল, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি।
এমন পরিস্থিতিতে এক জন মেয়ের মনের অবস্থা বোঝা সহজ নয়। অভ্যাসবশত চুলে হাত চলে যেত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মুঠো ভর্তি চুল উঠে আসত। যত বার হাত দিতাম, তত বার একই ঘটনা। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল, ঝরা পাতার মতো চুল পড়ে রয়েছে বালিশ-বিছানায়। কত বার নিজেকে সামলাবেন! না চেয়েও চোখের জল আটকাতে পারতাম না। এক সময়ে মাথা, ভ্রূ কোথাও একটিও চুল ছিল না। রান্না করার আগে অভ্যাসমতো চুল বাঁধতে যাচ্ছি, হঠাৎ খেয়াল হত চুলই তো নেই!
ঠাকুরপুকুর সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে আমার চিকিৎসা চলছে। ওখানে অনেক রোগীকে বলতে শুনেছি, আয়নার সামনে তাঁদের আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। এক বয়স্ক মহিলাকে চিনতাম, তিনি ঘরেও শাল বা স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতেন। মাথায় চুল ছাড়া অবস্থায় নিজেকে দেখতেই চাইতেন না তিনি। আরও এক জন কমবয়সি মেয়ে আছেন। কত বয়স হবে? ৩২-৩৩! উনি চাকুরিজীবী। ওঁদের লড়াইটা যেন আরও কঠিন। একে নিজের মনের সঙ্গে লড়াই, তার উপরে আবার বহির্জগতের সঙ্গে যুঝতে হয়। এই সময়ে অনেকেই নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখেন। এমন ক্যানসার রোগী আছেন, যাঁদের মাথায় চুল না থাকার জন্য ব্রাত্য হতে হয়েছে। ভয়ে নাকি কেউ তাঁদের সঙ্গে মিশছেন না। কোথাও গেলেই আশপাশে ফিসফিস, গুঞ্জন। কত কী যে চলে!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
সমাজটাও কেমন যেন! জানে সব, তবুও অবান্তর সব প্রশ্ন উড়ে আসে। ‘কী গো তোমার এত চুল ছিল, কোথায় গেল? কবে আবার চুল ফিরে আসবে?’ কেউ কেউ আড়ালে হাসবেন। বাস, ট্রাম, অটোয় কেউ আবার সহানুভূতির দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন। এ সবের মধ্যে মানসিক স্থিতি নড়বড়ে হওয়াটা অস্বাভাবিক কি? বিরক্ত হওয়ারই কথা। কিন্তু কিছু বলার নেই।
এমন অবস্থায় হাতিয়ার একটাই। নিজেকে বোঝানো। মনের জোর ধরে রাখা। কত সময়ে ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিতে হয়— কী হয়েছে? আবার চুল ফিরে আসবে। সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে। তা ছাড়া, শুধু চুল দিয়ে তো কারও ব্যক্তিত্ব মাপা যায় না। কিন্তু সে সব যতই বলি, ওই মানুষগুলির দৃষ্টি আগের মতো স্বাভাবিক হয় না। ফলে পরচুলের ব্যবহার এই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করে।
কিন্তু পরচুলা পরার প্রয়োজন হবে কেন?
আমার মেয়ের যখন মাধ্যমিক চলছে, তখন আমার স্তন ক্যানসারের জন্য কেমোথেরাপি চলছিল। আমি তো একা নই, এই লড়াই পুরো পরিবারকে লড়তে হয়েছে। কেমোথেরাপির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় কী ধরনের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা হয়, আড়াই বছর আগে প্রথম টের পেয়েছিলাম। রোগটা আবার ফিরে এসেছে। সেই সঙ্গে এসেছে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলিও। আমার বয়স ৪১, এখনই চুলের স্তর পাতলা হয়ে আসছে। পুরো ঝরে গেলে আবার পরচুলা পরব। তবে এখন আমি খুব শক্ত। জানি, কয়েক মাস পরে আবার মাথাভর্তি চুল হবে। প্রথম যখন গুঁড়ি গুঁড়ি চুল বেরোয়, তখন কী যে আনন্দ হয়!
তবে আড়াই বছর আগেও আমি আয়নার সামনে দাঁড়াতে ইতস্তত বোধ করতাম না, এখনও করি না। অনভিপ্রেত দৃষ্টির জন্য এটাই আমার জবাব ছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy