লুঠের টাকা কেবল ফুর্তি করা, বেড়াতে যাওয়া বা কেনাকাটায় কাজে লাগছে, এমনটা না-ও হতে পারে। এটিএম সাফ করে লুটে নেওয়া লক্ষ লক্ষ টাকা সন্ত্রাসবাদীদের হাতে পৌঁছে গিয়ে ব্যবহার হতে পারে দেশবিরোধী কার্যকলাপেও। এই আশঙ্কা থেকে এ বার ব্যাঙ্কগুলিকে সতর্ক করে দিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে লালবাজার।
গত মঙ্গলবার, ৩ মে রাতে দমদম সেভেন ট্যাঙ্কস ও নাগেরবাজারের প্রাইভেট রোডের দু’টি এটিএমে গ্যাস কাটার দিয়ে ভল্ট কেটে প্রায় ৩৭ লক্ষ টাকা লুঠ হয়। তার পরে ৬ মে শহরে ব্যবসা করা বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্ককে কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, এই বিপুল পরিমাণ টাকা সন্ত্রাসবাদীদের হাতে যাওয়া অস্বাভাবিক নয় এবং সে ক্ষেত্রে এই লুঠের ফল মারাত্মক হতে পারে।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দেবাশিস বড়াল বলেন, ‘‘মামুলি দুষ্কৃতী হলে এটিএম লুঠের টাকা ফুর্তি করে ওড়াবে, দামি জিনিস কিনবে। কিন্তু এর পিছনে জঙ্গিরা থাকলে অন্য বিপদ। সে ক্ষেত্রে এটিএম লুঠের টাকা দেশবিরোধী কাজে ব্যবহার করা হতে পারে। সেই জন্য ব্যাঙ্কগুলোর কাছ থেকে আরও বেশি সতর্কতা প্রত্যাশিত।’’
ব্যাঙ্ক লুঠের টাকা সন্ত্রাসবাদী কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বড় উদাহরণ রয়েছে তেলঙ্গানা রাজ্যের করিমনগরে। ২০১৪-র ১ ফেব্রুয়ারি সেখানকার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ৪৬ লক্ষ টাকা ডাকাতি হয়েছিল। সেই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের বিজনোরে একটি বিস্ফোরণ হয়। কুশীলবেরা অবশ্য পালিয়ে যায়। তবে তদন্তে উত্তরপ্রদেশ ‘অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াড’ (এটিএস) দাবি করে, বিজনোরে জেহাদি জঙ্গিদের একটি ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে এবং ওই জঙ্গিরাই করিমনগরের ব্যাঙ্ক ডাকাতিতে জড়িত ছিল।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা বলছেন, মাত্র দু’কিলোমিটারের মধ্যে দু’টি এটিএমে দুষ্কৃতীরা চড়াও হয়ে গ্যাস কাটার দিয়ে ভল্ট কেটে ৩৬ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা সাফ করে নিয়ে গিয়েছে। এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, ‘‘টাকার অঙ্ক যেহেতু এতটা বেশি, তাই মামুলি দুষ্কৃতীদের বাদ দিয়ে অন্য রকম সন্দেহ হচ্ছে।’’ মাওবাদী থেকে ভারতে ‘ইসলামিক স্টেট’ (আইএস)-এর শাখা, সম্প্রতি পরপর গোয়েন্দা অভিযানে ধরপাকড় জঙ্গি সংগঠনে টাকার ‘সাপ্লাই লাইন’ কেটে দিয়েছে। এই অবস্থায় বিপুল টাকা একলপ্তে হাতে পেতে ব্যাঙ্কে লুঠ সব চেয়ে কার্যকর, আর ব্যাঙ্ক ডাকাতির চেয়ে এটিএম লুঠে ঝক্কি ও ঝুঁকি সবই অনেক কম।
এক তদন্তকারী অফিসার জানান, একই রাতে গ্যাস কাটার দিয়ে পরপর দু’টি এটিএম লুঠের ঘটনায় তিনটি সম্ভাবনার কথা উঠে আসছে। এক, মামুলি ‘গ্যাং’, কিন্তু এটিএম লুঠে সিদ্ধহস্ত। দুই, কোনও জঙ্গি সংগঠনের কাজ। তিন, কোনও জঙ্গি সংগঠন কমিশনের বিনিময়ে স্থানীয় কোনও দুষ্কৃতী দলকে এতে নিয়োগ করেছে।
কিন্তু দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, সেভেন ট্যাঙ্কসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএম কাউন্টারে ক্লোজড সার্কিট টিভি ক্যামেরা ছিল নাম-কা-ওয়াস্তে, কারণ ছবি রেকর্ডিংয়ের কোনও ব্যবস্থা ছিল না তাতে। নাগেরবাজারে বেসরকারি ব্যাঙ্কের এটিএম কাউন্টারে সিসিটিভি-র ফুটেজে তিন দুষ্কৃতীর অস্পষ্ট ছবি মিলেছে।
কলকাতায় রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ২২টি ব্যাঙ্ক ব্যবসা করে। লালবাজার সূত্রের খবর, সম্প্রতি কলকাতা লাগোয়া একটি জায়গায় দেখা গিয়েছে, টাকা বার করে নিতে দুষ্কৃতীরা যখন গ্যাস কাটার দিয়ে এটিএম কাটছিল, সেই সময়ে তাপে ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার (ডিভিআর)-ও গলে গিয়েছে। অর্থাৎ, সিসিটিভি-র ফুটেজ পাওয়ার আর কোনও উপায় নেই। আবার খুপরিতে সিসিটিভি ক্যামেরা ছাড়াও এটিএমের মধ্যে বসানো গোপন ক্যামেরাটি ঠিকঠাক কাজ করছে কি না, তা-ও নিশ্চিত করা দরকার বলে মনে করছে পুলিশ। ৬ মে লালবাজার তাই ব্যাঙ্কগুলিকে লিখিত ভাবে এটিএমে নজরদারিতে অফিসার নিয়োগ, ফুটেজ নিয়মিত দেখা, ক্যামেরার অবস্থান সংক্রান্ত কিছু নির্দেশ দিয়েছে। স্টেট ব্যাঙ্কের এক কর্তার অবশ্য দাবি, তাঁদের অফিসারোরাই নিয়ম করে এটিএম কাউন্টারের সিসি ক্যামেরার ছবি ও ফুটেজ খতিয়ে দেখেন। পাশাপাশি তাঁর দাবি, ‘‘সাম্প্রতিকতম ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, লুটেরারা এটিএমের হার্ড ডিস্ক খুলে নিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, এটিএমের খুঁটিনাটি তাদের জানা।’’
লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘এটিএমের বিমা থাকার ফলে চুরি বা লুঠ হয়ে যাওয়া টাকা পুরোটাই ব্যাঙ্ক পেয়ে যায়। নিরাপত্তায় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাঙ্কগুলির ঢিলেমির এটা একটা বড় কারণ। কিন্তু বিমার টাকাও তো জনগণের। এটা ভেবে ব্যাঙ্কগুলিকে সতর্ক থাকতেই হবে।’’
এটিএম লুঠে আটক ৩
দমদম-নাগেরবাজার এলাকার দু’টি ব্যাঙ্কের এটিএম লুঠের ঘটনায় ঝাড়খণ্ডের পাকুড় থেকে তিন দুষ্কৃতীকে আটক করল কলকাতা পুলিশ। পুলিশ জানায়, রবিবার রাতে মনজিৎ গুপ্ত, শওকত মোল্লা এবং উপেন্দ্র শাহ নামে ওই তিন জনকে কলকাতায় আনা হয়। গত সপ্তাহে দমদম-নাগেরবাজার এলাকায় দু’কিলোমিটারের মধ্যে রক্ষীবিহীন দু’টি এটিএমের ভল্ট কেটে লুঠ হয়েছিল প্রায় ৩৮ লক্ষ টাকা। পুলিশের দাবি, ধৃতদের থেকে লুঠের টাকা উদ্ধার হয়নি। তবে পুলিশ জেনেছে, ওই তিন জনের বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন থানায় ব্যাঙ্ক ডাকাতি, খুন-সহ একাধিক অপরাধের অভিযোগ আছে। এটিএম-এর ভল্ট কেটে টাকা লুঠের সময়ে সিসিটিভি-র সংযোগও কেটে দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ থেকে কয়েক জন সন্দেহভাজন দুষ্কৃতীর ছবি পান তদন্তকারী অফিসারেরা। সেই সূত্রেই পুলিশ পৌঁছয় ঝাড়খণ্ডে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy