Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সরেজমিন আনন্দবাজার

অনলাইন ‘শিকেয়’, কড়ি ফেললেই ভর্তি

বেলা আড়াইটে। কলেজের মূল গেটের বাইরে ছাত্র সংসদের নেতা-কর্মীরা ছোট ছোট ‘স্লিপ’ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কলেজ সংলগ্ন বেসরকারি ব্যাঙ্কের শাখায় চলছে ফর্ম পূরণের পরে চালান নিয়ে টাকা জমা দেওয়ার কাজ। কিন্তু কলেজের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না কাউকেই। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে ছাত্রী ও তার অভিভাবক সেজে গেট দিয়ে ঢুকতে গেলে দারোয়ান বাধা দিয়ে বললেন, এ বছর অনলাইনে ভর্তি হচ্ছে।

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।

দীক্ষা ভুঁইয়া ও মধুরিমা দত্ত
শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৫ ০০:৩৫
Share: Save:

বেলা আড়াইটে। কলেজের মূল গেটের বাইরে ছাত্র সংসদের নেতা-কর্মীরা ছোট ছোট ‘স্লিপ’ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কলেজ সংলগ্ন বেসরকারি ব্যাঙ্কের শাখায় চলছে ফর্ম পূরণের পরে চালান নিয়ে টাকা জমা দেওয়ার কাজ। কিন্তু কলেজের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না কাউকেই। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে ছাত্রী ও তার অভিভাবক সেজে গেট দিয়ে ঢুকতে গেলে দারোয়ান বাধা দিয়ে বললেন, এ বছর অনলাইনে ভর্তি হচ্ছে।

দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই হঠাৎ বছর বাইশের সুদর্শন এক যুবক এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, কী দরকার। বোনকে ভর্তি করাতে আসা হয়েছে শুনেই নানান জিজ্ঞাসা। ভূগোল অনার্সে ভর্তির কথা শুনে সটান জবাব ‘সম্ভব নয়।’ পরক্ষণেই জানালেন, একটা রাস্তা অবশ্য খোলা রয়েছে। তা বাতলে দিলেন যুবক নিজেই। কলেজ থেকে হাঁটা দূরত্বে একটি সাইবার কাফে দেখিয়ে বললেন, ‘‘ওখানে গিয়ে ফর্মটা পূরণ করুন’। তাঁর পরামর্শ মতো সেখানে পৌঁছতেই দেখা গেল, ছোট ওই দোকানে মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি আর পাশে কম্পিউটার নিয়ে আরও দুই যুবক বসে ফর্ম পূরণ করছেন। সামনে কাগজপত্র হাতে দু’জন মেয়ে এবং কিছু ছেলে দাঁড়িয়ে। ভিতরে ঢোকা ঠিক হবে কি না ভাবতে ভাবতে সেখানেও পৌঁছে গেলেন ওই ছাত্রনেতা। কিন্তু আমাদের হাতে তো মার্কশিট বা কাগজপত্র নেই! তাতে কী? বাড়ি কোথায়, কাগজপত্র নিয়ে আসতে কতক্ষণ লাগতে পারে— নানা তথ্য জানার পরে তাঁর উত্তর, ‘‘এখুনি চলে যান। মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড এবং উচ্চ মাধ্যমিকের মার্কশিটের প্রতিলিপি নিয়ে আসুন। যত দেরিই হোক। তা হলে আজই বোনের জন্য আসন ‘বুক’ করে রাখবেন। বুঝতেই পারছেন, ‘ফার্স্ট কাম, ফার্স্ট সার্ভ’।’’ তবে এ সবের জন্যই গুনতে হবে মোটা অঙ্কের টাকা। টাকার পরিমাণ অবশ্য ফর্ম জমা দেওয়ার পরেই জানাবেন।

নম্বর কম থাকা সত্ত্বেও কী করে তিনি ‘দায়িত্ব’ নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেবেন, তার নমুনাও মিলল হাতেনাতে। কথাবার্তার মাঝখানেই এক যুবক দু’টি ছাপানো আবেদনপত্র-সহ হাজার টাকার একটি মোটা বান্ডিল এনে তাঁর হাতে গুঁজে দিলেন। সুদর্শন যুবক নিজেই বললেন, ‘‘এই হচ্ছে ছাপানো ফর্ম আর টাকা।’’ সংবাদমাধ্যমের ভয়ে তাঁরা যে শুক্রবার থেকে কলেজের সামনে বসা ‘হেল্প ডেস্ক’ উঠিয়ে দিয়েছেন, তা-ও স্বীকার করলেন ওই ছাত্রনেতা। খোদ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগের পরের দিনই এ ছবি ধরা পড়ল খাস সুরেন্দ্রনাথ কলেজে।

কী বলেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী?

বৃহস্পতিবার টাউন হলে এক অনুষ্ঠানের শেষে তিনি জানিয়েছিলেন, অনলাইন প্রক্রিয়ায় ভর্তি ‘টোটাল ফেলিওর’। আর এর পিছনে মদত রয়েছে এক শ্রেণির শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এবং ছাত্র নেতার। তাঁর কড়া হুঁশিয়ারি ছিল, ইউনিয়নের নেতারা এ সব বন্ধ না করলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর হুমকিকেও কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কলেজে কলেজে চলছে টাকার বিনিময়ে ভর্তির রমরমা ব্যবসা। আর অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্র নেতারা ভর্তির নামে এই আসনগুলিকে নিজেদের ‘কোটা’ বলে চালাচ্ছেন। অথচ, রাজ্য স্তরের এক ছাত্র নেতারই দাবি, গত সাত-আট বছরের উপরে কোনও ইউনিয়নের এই জাতীয় আসন দখলে নেই। পুরোটাই চলে সংশ্লিষ্ট কলেজগুলির অধ্যক্ষদের উপর চাপ সৃষ্টি করে।

কী ধরনের চাপ? এই ছাত্রনেতার কথায়, ভর্তি চলাকালীনই ছাত্রনেতারা বুঝে যান ক’টি আসন বিক্রি করতে হবে। সেই হিসেবে আসন-সংখ্যা নিজেদের নামে সংরক্ষণের জন্য অধ্যক্ষকে বলে রাখেন তাঁরা। আর শাসকদলের ছাত্র সংসদকে ‘না’ বলার ক্ষমতাই থাকে না কর্তৃপক্ষের। ওই নেতার দাবি, শুধু মাঝারি মাপের কলেজ নয়। বেশ কিছু ভাল কলেজের আসনও এ ভাবেই আগে থেকে দখল করে রাখেন ইউনিয়নের ‘দাদারা’।

যেমন, আশুতোষ কলেজ। সুরেন্দ্রনাথ থেকে দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ সেখানে পৌঁছেও একই বাধার সম্মুখীন হতে হল। কলেজের গেটেই জানানো হল, সব অনলাইনে ভর্তি হতে হচ্ছে। কিন্তু নম্বর কম থাকলে? জিন্‌স আর সাদা শার্টের ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির যুবকের উত্তর, আশুতোষে ভূগোল বা ইংরেজিতে কম নম্বর নিয়ে ভর্তি সম্ভব নয়। তবে ফর্ম পূরণ করতে বাধা নেই। তাঁর স্পষ্ট উত্তর- ‘‘কাল সাড়ে ১২টার মধ্যে চলে আসুন। আমাদের ছেলেদের বলে রাখব। অনলাইনেই ফর্ম পূরণ করে, টাকা দিয়ে কাগজটা আমাকে দিয়ে যাবেন। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’’ কত লাগবে? — তাঁর উত্তর ‘‘সেটা তখন বলব।’’

শ্যামাপ্রসাদ কলেজেও ভূগোলে আবেদন করে রাখতে বললেন ওই যুবক। জানালেন, পরে সেখান থেকে ‘ট্রান্সফার’ করাটা ‘ওঁদের’ হাতে। তবে কলেজের ছাত্র সংসদের এজিএস-এর কথায়, কোনও বিষয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ভর্তি হতে গেলে আর একটু বড় ‘দাদাদের’ অনুমতি নিতে হয়।

প্রায় একই ভাবে ভর্তি হওয়া সম্ভব গোলপার্কের সাউথ সিটির দিবা-বিভাগ হেরম্বচন্দ্রেও। সেখানে কলা বিভাগে ইংরেজি এবং ভূগোলে ভর্তির চাহিদা বরাবরই বেশি। তবে এখানেও ছাত্র নেতাদের টপকে ভর্তি হতে আসা প্রার্থীদের কলেজে ঢোকার অনুমতি নেই। এ দিন মোটরসাইকেলে বসা হোমড়া-চোমড়া ‘দাদা’ পরামর্শ দিলেন, কম নম্বরে ভূগোল না পড়ে বাংলা অনার্সের জন্য আবেদন করার। তিনি তার ব্যবস্থা করে দেবেন। নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে ওই ‘দাদা’র বক্তব্য, টাকার পরিমাণ তিনি পরে বলবেন। ভর্তি তো এক মাস দেরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE