জলা ঘুরে দেখছেন হাইকোর্ট নিযুক্ত স্পেশ্যাল অফিসার। রবিবার, পানিহাটিতে। — নিজস্ব চিত্র
তিনি আসবেন বলে এলাকা তখন রীতিমতো সরগরম। গাড়ি থেকে নামলেন এক নবীনা।
কে তিনি? কেনই বা তাঁকে ঘিরে সরগরম আপাতশান্ত এক পাড়া?
তাঁর নাম প্রমিতি বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী। রবিবার পানিহাটিতে এসেছেন বহু পুরনো এক মামলার প্রেক্ষিতে, যার ইতিহাস বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
পানিহাটির রামকৃষ্ণ পার্কে কয়েক বিঘার একটি জলাশয়ে আবর্জনা ফেলে দূষিত করার অভিযোগ রয়েছে পুরসভারই বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে এর আগে হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ ময়লা তুলে জলাশয়টিকে তার আগের চেহারায় ফেরানোর নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হয়নি। ফের মামলা গড়ায় বর্তমান প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে।
গত শুক্রবার মামলাটি শুনানির জন্য ওঠে। আবেদনকারীর অভিযোগ, পুর-কর্তৃপক্ষের মদতেই পুরসভার বর্জ্য ফেলে বোজানো হচ্ছে ওই পুকুর। শুনানির সময়ে এজলাসে উপস্থিত ছিলেন নবীনা আইনজীবী প্রমিতিদেবী। গুরুত্বপূর্ণ এই মামলায় তিনি ‘স্পেশ্যাল অফিসার’-এর দায়িত্ব নিতে রাজি কি না, জানতে চান প্রধান বিচারপতি। তিনি সম্মতি জানানোয় হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত নেয়, এত দিন ধরে চলে আসা এই জনস্বার্থ মামলার পরিদর্শনের ভার দেওয়া হবে নবীনা প্রমিতিকেই। প্রসঙ্গত, প্রমিতিদেবী আরও এক পরিচয় আছে। তিনি তৃণমূলের আইনজীবী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে।
রবিবার যখন রামকৃষ্ণ পার্কে পৌঁছলেন প্রমিতিদেবী, তখন বেলা প্রায় এগারোটা। হাইকোর্টের তরফে তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছিল ঘোলা থানাকে। তাই প্রমিতির সঙ্গে ছিলেন ওসি সুপ্রকাশ পট্টনায়ক।
এলাকার কিছু বাসিন্দার অভিযোগ, জলাশয় দূষণে দায়ী পুরসভাই। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, হাইকোর্টের প্রতিনিধিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা থাকবে নানা মহলে। পৌঁছনো মাত্র প্রমিতিদেবীর দিকে ছুটে এলেন পানিহাটি পুরসভার আইন-অফিসার বিকাশ চট্টোপাধ্যায়। বললেন, ‘‘সামলে দিদিমণি, নোংরা আছে।’’ আর এক পুর-অফিসার এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘আরে প্রমিতি তো আমাদেরই লোক। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে।’’ তা শুনেই চোখেমুখে কিছুটা বিরক্তি ফুটে ওঠে হাইকোর্টের প্রতিনিধির। বলেন, ‘‘আমি এখানে হাইকোর্টের নির্দেশে একটা নির্দিষ্ট কাজে বিশেষ দায়িত্বে এসেছি। এই জলাশয় নিয়ে যে অভিযোগ হয়েছে, তার বাইরে বাকি কথা অপ্রয়োজনীয়।’’ তার পরেই কাদা ঠেলে শাড়ি সামলে মোবাইলে জলা দূষণের ছবি তুলতে থাকেন। সহকারীকে নির্দেশ দেন নোট নিতে।
এ দিন এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, ওই জলাশয়ের তিন দিকে রাস্তা। তিন দিকেই বাঁশের খুঁটি আর টিন দিয়ে পাড় বাঁধানো। রাস্তার ধারে ট্রান্সফর্মার, গাছে পুরসভার পক্ষ থেকে কাগজের পোস্টার সাঁটা। তাতে লেখা— ‘‘পুকুরের পাশে ইট, বালি, ইমারতির জিনিস রাখা যাবে না’’, ‘‘পুকুর ভরাট করা যাবে না’’, ‘‘পুকুর পরিষ্কার রাখতে হবে’’। এলাকার কিছু বাসিন্দার অভিযোগ, হাইকোর্টের প্রতিনিধি আসছেন শুনেই তড়িঘড়ি এ সব পোস্টার লাগিয়েছে পুরসভা। প্রমিতিদেবীরও নজর যায় সে দিকে। প্রমিতিদেবী একটি পোস্টার দেখিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘‘এটা কি আজই লাগানো হয়েছে?’’ বিকাশবাবু তড়বড়িয়ে জবাব দেন, ‘‘না না, কয়েক দিন আগে।’’ পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘কাল থেকে যা বৃষ্টি হয়েছে, তাতে আঠা লাগানো কাগজের পোস্টার এক দিনও থাকার কথা কি?’’ এর অবশ্য উত্তর মেলেনি।
হাইকোর্টের প্রতিনিধি যখন পুরসভাকে প্রশ্নে জেরবার করছেন, তখন অন্য দিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে শাসক দলের লোকেদের হাতাহাতি হওয়ার জোগাড়। এর মধ্যে একটি মানবাধিকার সংগঠনের সদস্যদের উপরে কার্যত চড়াও হতে দেখা যায় স্থানীয় কাউন্সিলর প্রদীপ বড়ুয়া ও তাঁর অনুগামীদের। প্রদীপবাবুর বক্তব্য, জলাশয়ের জন্য রাস্তা ভেঙে যেত। তাই গার্ডওয়াল দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ এবং মানবাধিকার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ধীরাজ সেনগুপ্তের বক্তব্য, রাস্তা প্রয়োজনীয়। কিন্তু আবর্জনা ফেলে গার্ডওয়াল হচ্ছে। তা দূষণ ছড়াচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy