Advertisement
০২ মে ২০২৪
Cyclone Amphan

মৃত্যুভয়! মনে হল, এটাই কি কলকাতা

গাড়ি ধীরে ধীরে পার্ক সার্কাস মোড়ের দিকে যত এগিয়েছে, সাইক্লোনের তীব্রতা ততই আরও বেড়েছে।

টিপু সুলতান মসজিদের কাছে গাছ উপড়ে বন্ধ রাস্তা। ছবি: পিটিআই।

টিপু সুলতান মসজিদের কাছে গাছ উপড়ে বন্ধ রাস্তা। ছবি: পিটিআই।

আর্যভট্ট খান
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২০ ০৪:০৮
Share: Save:

শুধু বৃষ্টি পড়ছিল অঝোরে। বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টে থেকে সেই বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হল তীব্র হাওয়া। বৃষ্টির গতিবেগও বাড়ছিল ক্রমশ। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, কলেজ স্ট্রিট, গিরিশ পার্ক, হেদুয়া, শোভাবাজার সব রাস্তাঘাট আমপানের আগমনের খবর পেয়েই যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। গত দু’মাস ধরে লকডাউনের জন্য শহরের রাস্তা অনেকটাই সুনসান। কিন্তু এরকম শূন্যতা বোধহয় এত দিন ছিল না। গাড়ি যত উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে যাচ্ছে, ততই দেখি বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ছে। আর বাড়ছে হাওয়ার গতিবেগ।

বিকেল পৌনে ৫টা। শিয়ালদহ পেরিয়ে সামনের সুনসান রাস্তায় দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম ঝড়ের তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে। রাস্তার আশপাশের গাছের ডালগুলো এমন ভাবে দুলছিল যে মনে হচ্ছিল গাছে একটা খ্যাপা হাতি চেপে বসে গাছগুলোকে ঝাঁকাচ্ছে। সামনে কি আর এগোতে পারব? নাকি কোথাও আশ্রয় নেব? কিন্তু কোথায় দাঁড়াব? ফুটপাতে দোকানগুলোর প্লাস্টিক ছাউনি একের পর এক উড়ে যাচ্ছে। বড় বড় হোর্ডিংগুলোতে ধাক্কা মারছে ঝোড়ো হাওয়া আর মনে হচ্ছে, সব হোর্ডিং ভেঙে পড়বে মাথায়। মোড়ের সিগন্যালগুলো এমন ভাবে দুলছে, মনে হচ্ছিল সাইক্লোনের সঙ্গে ভূমিকম্পও হচ্ছে।

গাড়ি ধীরে ধীরে পার্ক সার্কাস মোড়ের দিকে যত এগিয়েছে, সাইক্লোনের তীব্রতা ততই আরও বেড়েছে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেঘ যেন অনেকটা নীচে নেমে এসেছে। জানলার কাচ

সামান্য নামাতেই এমন হাওয়ার ঝাপটা খেলাম!

দুর্যোগের মধ্যে গড়িয়াহাট মোড়ের দিকে যত এগোচ্ছি, ঝড়ের তীব্রতা বাড়ছে। মনে হচ্ছে ক্রমশ যেন সাইক্লোনের পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি। ঠিক করলাম, যে করেই হোক গড়িয়াহাট ফ্লাইওভার পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। ফ্লাইওভারের নীচে অনেকটা জায়গা আছে। ওখানে দাঁড়ালে অন্তত মাথা বাঁচাতে পারব। কিন্তু এই তাণ্ডবের মধ্যে পৌঁছতে পারব কি গড়িয়াহাট পর্যন্ত? কী ভাবে পৌঁছব? আমার সঙ্গে থাকা ফোটোগ্রাফার সুদীপ্ত বলল, ‘‘চলো দেখি,

চেষ্টা তো করি। এখানে দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়?’’

পরিস্থিতি কিন্তু ক্রমশই খারাপ হচ্ছে। গাড়ির জানলা না খুলেই বুঝতে পারলাম, ওই খ্যাপা হাতিটা শুধু তাণ্ডবই চালাচ্ছে না, সেই সঙ্গে বিকট আওয়াজও করছে। অজস্র গাছ ভেঙে পড়ে আছে। করোনার জন্য তৈরি করা কন্টেনমেন্ট এলাকার ব্যারিকেড দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে রাস্তায়। তীব্র হাওয়ায় বৃষ্টির জল সোজা না পড়ে ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ছে। সামনে ভাল দেখা যাচ্ছিল না। রাস্তায় আমাদের গাড়িটা তখন যেন উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে একটা ছোট্ট ডিঙি নৌকা। সে এক উথালপাথাল দশা।

বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পেরিয়ে দেখি, রাস্তার ধারে সব গাছ খুব জোরে দুলছে। একটা নির্দিষ্ট গাছ অনেক বেশি দুলতে শুরু করল। চালক গাড়ি থামিয়ে দিলেন। আর তখনই চোখের সামনে দেখলাম। ১০০ মিটার দূরে একটা বড় গাছ ডালপালা সুদ্ধ ভেঙে পড়ল। তা হলে কি আর যেতে পারব না গড়িয়াহাট পর্যন্ত?

রাস্তায় তখন জল জমতে শুরু করেছে। কোথাও এক হাঁটু জল। জলে ভেসে যাচ্ছে গাছের ডালপালা। কোথাও কোথাও বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়েছে। তারই মধ্যে কোনও ক্রমে গড়িয়াহাট মোড়ে এসে দেখলাম, চার দিক অন্ধকার। ফ্লাইওভারের নীচে ফুটপাতের বাসিন্দাদের সংসার পুরোপুরি তছনছ। পুলিশের কিয়স্কও আছে সেখানে। কয়েক জন পুলিশকর্মী অন্ধকারে বসে। কোনও মতে সেখানেই ঢুকে পড়লাম। বাইরে তখনও সাইক্লোনের তাণ্ডব। মৃত্যুভয় নিয়ে বসে থাকতে থাকতে মনে হল, এ আমরা কোথায় বসে আছি? এটাই কি কলকাতা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Amphan Cyclone Storm Rainfall
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE