Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘মার মার, পুরো শেষ করে দে’

রবিবার সারা রাত আর ঘুমোতে পারিনি। চোখ বোজার চেষ্টা করলেই মনে পড়ছে, লাঠিপেটার সেই নির্মম দৃশ্য। কুকুরছানাগুলোর ওই কান্না!

হস্টেলের ঘরে সৌরভ চক্রবর্তী। নিজস্ব চিত্র

হস্টেলের ঘরে সৌরভ চক্রবর্তী। নিজস্ব চিত্র

সৌরভ চক্রবর্তী 
(আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া, ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োটি তিনিই তোলেন) শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৩২
Share: Save:

রবিবার সারা রাত আর ঘুমোতে পারিনি। চোখ বোজার চেষ্টা করলেই মনে পড়ছে, লাঠিপেটার সেই নির্মম দৃশ্য। কুকুরছানাগুলোর ওই কান্না!

চোখের সামনে দেখেছি, কী ভাবে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নার্সিং হস্টেলের মেয়েরা কুকুরছানাগুলোকে পিটিয়ে মারছেন। আমিই ভিডিয়ো করে রেখেছিলাম। অনেকে বলছেন, ভিডিয়ো করতে পারলাম অথচ বাঁচালাম না? বিশ্বাস করুন, চিৎকার করে প্রতিবাদ করেছি। ওরা থামেনি। বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতে না পারার যন্ত্রণা কিছুতেই যাচ্ছে না। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে তাই ঠিক করি, ওই কুকুরছানাগুলোকে যে খুন করা হয়েছে, সেই সত্যিটা চেপে যাওয়া যাবে না। আমিই ভিডিয়োটা পশু অধিকার রক্ষা কর্মীদের পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। রাতে দেখলাম সেটাই ভাইরাল হয়েছে। দোষীদের কড়া শাস্তি হোক। পুলিশ আমাদের সঙ্গে কথা বলুক, সব বলব।

রবিবার তখন সকাল সাড়ে ১১টা। ছুটির দিন বলে একটু দেরিতে উঠেছিলাম। আমি আর আমার রুমমেট আরবান ডগলাস ঘরে বসে গল্প করছি, হঠাৎ বাইরে প্রবল চিৎকার। জানলার কাছে গিয়ে দেখি, এন আর এস হাসপাতালের নার্সিং হস্টেলের ভিতরে একটি কুকুরছানাকে বাঁশ দিয়ে বেধড়ক মারছেন দুই মহিলা। যন্ত্রণায় চিৎকার করছে কুকুরছানাটা। দূরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখছেন আরও কয়েক জন মহিলা। সকলেই চেঁচিয়ে চলেছেন, মার মার। পুরো শেষ করে দে।

আরও পড়ুন: পিটিয়েই খুন কুকুর, প্রশ্নের মুখে ছয়

আমাদের হস্টেলের ঘর থেকে ওই জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যায়। ডগলাস আর আমি এর পরে চিৎকার করতে শুরু করি। ওদের তখন কোনও দিকে হুঁশ নেই। ডগলাস বলল, শুনছে না যখন, ভিডিয়ো কর! মারতে মারতে কুকুরছানাটাকে মেরেই ফেলল ওরা। এর পরে একটা সাদা প্লাস্টিক টেনে তাতে ভরে দিল। প্লাস্টিকের ভিতরেও আরও একটা মৃত কুকুরছানা ছিল।

আমরা প্রতিবাদ করায় ওই মহিলারা বললেন, এত যখন দরদ, নিজেরা নিয়ে যান। আপনাদের হস্টেলেই রাখুন। আমাদের কামড়ায়। জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বাঁচতে দেওয়া যাবে না। এর পরে আর একটি কুকুরছানাকে ওই ভাবে মারতে শুরু করে ওরা।

ঘটনাটা এমন ভাবে হয়েছে, প্রথমে কাউকে কিছু বলারই সুযোগ পাইনি। তার পরে ভয় হল, যদি ওদের হাসপাতালের উঁচু মহল থেকে বলিয়ে আমাদের এখানে থাকা বন্ধ করে দেয়? যদি বলে, আমরা মেয়েদের হস্টেলের নানা দৃশ্য মোবাইলে ভিডিয়ো করি? বাবা অনেক কষ্ট করে পড়তে পাঠিয়েছেন। প্রথমে তাই দমে গিয়েছিলাম। পরে মনে হল, চুপ করে থাকা যাবে না। ভিডিয়ো-সহ মেল করলাম পশু অধিকার রক্ষা সংগঠনে।

আমার বাড়ি পুরুলিয়ায়। বাবা সরকারি দফতরে চাকরি করেন। পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে পড়েছি। ২০১৬ সালে ডাক্তারি পড়তে কলকাতায় আসি। এই হস্টেলে রয়েছি মাস ছ’য়েক। ২২ বছরের জীবনে এমন ঘটনা কখনও দেখিনি। গোটা হস্টেলে আজ সারা দিন এই আলোচনা চলেছে। একটা জিনিস ভেবে অবাক লাগছে, পুলিশ আমাদের সঙ্গে এখনও কথাই বলল না! অনেক বন্ধু ভয় পাচ্ছে, হাসপাতাল থেকে বলবে, কেন সব বলেছ? কেন ভিডিয়ো করেছ? এখন একটাই কথা মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস ভিডিয়োটা করেছিলাম। না হলে আমাদের মুখের কথায় কেউ বিশ্বাস করতেন?

বাচ্চাগুলোকে বাঁচানোর জন্য কিছুই করতে পারিনি। অন্তত এই ভিডিয়োটা দেখে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা হোক।

(নীলোৎপল বিশ্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE