Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

সঙ্গী আতঙ্ক, অগতির গতি তবু মেট্রোই

যানজট ঠেলে ভিড় বাসে ওঠার ঝক্কি পোহাতে আর ইচ্ছে করেনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আরও কয়েক জন সহযাত্রীর সঙ্গে হেঁটে সেন্ট্রাল স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী জিনিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়।

ব্যস্ততা: ময়দান স্টেশনে মেট্রোয় ওঠানামা যাত্রীদের। শুক্রবার সকালে। ছবি: শৌভিক দে

ব্যস্ততা: ময়দান স্টেশনে মেট্রোয় ওঠানামা যাত্রীদের। শুক্রবার সকালে। ছবি: শৌভিক দে

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:০৫
Share: Save:

ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগেই পাতালে সাক্ষাৎ ‘নরকদর্শন’-এর অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। কিন্তু বাড়ি ফেরার তাগিদে সেই সন্ধ্যাতেই ফের মেট্রোয় উঠতে হয়েছিল নৈহাটির মহিলাকে।

যানজট ঠেলে ভিড় বাসে ওঠার ঝক্কি পোহাতে আর ইচ্ছে করেনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আরও কয়েক জন সহযাত্রীর সঙ্গে হেঁটে সেন্ট্রাল স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী জিনিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘এটা সাহস নয়, উপায়হীনতা বলতে পারেন। সপ্তাহে তিন দিন দমদম থেকে গড়িয়ার অফিসে চলাফেরা করতে হলে আর কী করি বলুন তো!’’ এবং ওই মেট্রোযাত্রীর দাবি, এত বড় বিপর্যয়ের সেই সন্ধ্যায় ফের তাঁদের ট্রেনের কামরায় কিছু ক্ষণের জন্য আলো নিভে যায়। তবু যাত্রীরা ফের মেট্রোরেলের দ্বারস্থ হয়েছেন।

শুক্রবার সকালেও খানিকটা তটস্থ ভঙ্গিতে মেট্রোয় উঠতে বাধ্য হয়েছিলেন পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি রাজীব দাস। বিভীষিকার সময়ে প্রাণভয়ে ভাঙা জানলা দিয়ে লাফিয়ে নেমে পাতাল থেকে বেরিয়েছিলেন তিনি। এ দিন ফের রবীন্দ্র সরোবর ও ময়দানের মধ্যে যাতায়াত করেছেন রাজীব। তাঁর কথায়, ‘‘এত অস্থির লাগছিল, দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু এত ভয়ের মধ্যেও সেই মেট্রোয় চড়তে হল।’’ দুপুরে রবীন্দ্র সদন থেকে ময়দানে ওঠার সময়ে এক তরুণী বান্ধবীকে বলছিলেন, ‘‘আজকেও এত ভিড় হবে ভাবিনি।’’

একটা সময়ে মুম্বইয়ে লোকাল ট্রেনে জঙ্গিহানার পরেই রুটিরুজির টানে পথে নামা আমনাগরিককে কুর্নিশ জানানোর রেওয়াজ চালু হয়েছিল সংবাদমাধ্যমে। এই প্রবণতাকে তখন ‘মুম্বই স্পিরিট’ও বলা হত। নিরাপত্তাহীনতার বোধ এবং আতঙ্কের আবহে বহু মুম্বইবাসীর ক্ষেত্রে তা বিরক্তিরও কারণ হয়ে উঠেছিল। শুক্রবার কলকাতার মেট্রোরেলের আপাত স্বাভাবিক ছবিটার মধ্যেও অনেকে হার না-মানা মনোভাব দেখেছেন। সকালে অফিসের ব্যস্ত সময়ে ঠাসা ভিড়ে দরজা বন্ধ হতে তো রীতিমতো সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু মেট্রোয় ভিড়ের এই চিরাচরিত ছবিটার আড়ালে এক ধরনের চাপা ক্ষোভও এ দিন মালুম হয়েছে।

রামমন্দিরের বাসিন্দা, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র সঞ্জিত সিংহ জানলার কাচ ভাঙতে গিয়ে হাতে চোট পেয়েছিলেন। ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছে তাঁকে। এ দিন সকালে ফুঁসে উঠে বলছিলেন, “মেট্রোয়ে ওঠা তো ছাড়তে পারব না, কিন্তু এ ভাবে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে ছেলেখেলা আর কতদিন চলবে?’’ কামরার ভিতরে আগুন নেভানোর যন্ত্রটা যাত্রীদের কাজে লেগেছিল জানলায় বাড়ি মারতে। সঞ্জিতের প্রশ্ন, ‘‘বিপদের সময়ে যাত্রীদের কাচ ভেঙে বার করার মতো ব্যবস্থা কেন থাকবে না কামরার ভিতরে?’’ সাধারণত, বিমান অশান্ত আবহাওয়ার মধ্যে পড়লে ককপিট থেকে যাত্রীদের শান্ত হয়ে বসতে বলা হয়। বারাসতের বাসিন্দা, চাঁদনি চকের কম্পিউটার মেকানিক সুদেব প্রামাণিক বা হায়দরাবাদবাসী অস্মিতা ভট্টাচার্যের ক্ষোভ, বিপদের সময়ে ‘পাবলিক অ্যাড্রেস’ সিস্টেমে মেট্রোর তরফে আশ্বস্ত করা হয়নি কেন? ইঞ্জিন থেকে চার নম্বর কামরার যাত্রী সুদেবের কথায়, ‘‘আমার তো ২২ বছর বয়স! তাতেই আর আধ ঘণ্টা ভিতরে থাকতে হলে, দম আটকে বেঁচে থাকতাম কি না সন্দেহ!’’

মেট্রো কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, বিপর্যয়ের সময়ে সবাইকে শান্ত থাকতে বলে টুইট করা হয়েছিল। তা ছাড়া কন্ট্রোল রুম থেকেই ঘোষণা করা হয়, যা সব স্টেশনেই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু বিপদের মুখে পড়া ট্রেনের যাত্রীদের আলাদা করে তা শোনানোর কোনও বন্দোবস্ত ছিল না। যাদবপুরের ছন্দক চট্টোপধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘‘বিমান ছাড়ার আগে সুরক্ষা-বিধি প্রচারের মতো মেট্রোর স্টেশনে-স্টেশনে কেন সতর্কতার পাঠ দিতে ভিডিয়ো চালায় না মেট্রো?’’

পেশায় গ্রিন পুলিশকর্মী কবিতা মণ্ডলও টালিগঞ্জ থেকে ধর্মতলার পথে এ বার মেট্রোর আতঙ্ক-যাত্রার শরিক হয়েছিলেন। ঠেলাঠেলির মধ্যে ব্যাগ খোয়া যায় তাঁর। এ দিন ফোন করে এক ব্যক্তি তাঁর ব্যাগ ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু বালির বাসিন্দা কবিতা ভাবছেন, আর মেট্রোয় যাতায়াত করা ঠিক হবে কি না। ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সের শম্পা বসু বা রামন্দিরের কাপড়ের

ব্যবসায়ী অনুপ সিংহও এ বার আতঙ্কের জেরে এ দিন আর মেট্রোয় ওঠেননি। মেট্রোয় উঠলেও এসি কামরা এড়িয়ে চলেন বেলগাছিয়ার অমরনাথ রক্ষিত। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই মানছেন, দু’-এক দিন পিছপা হলেও কলকাতায় মেট্রোবিহীন জীবন তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fear Fire Kolkata Metro
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE