Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Gangrape

মধ্য রাতে বদলে যাওয়া ফুটপাতে শুয়ে তিন বছর ধরে বিচারের আশায় ‘দিশা’র পরিবার

দিশাকে মনে আছে? দিল্লির ‘নির্ভয়া’র থেকে কোনও অংশে কম ভয়ানক ছিল না এই শহরের দিশা-কাণ্ড।

ফুটপাতে এ ভাবেই রাতের পর রাত কেটে যায়। প্রতীকী ছবি

ফুটপাতে এ ভাবেই রাতের পর রাত কেটে যায়। প্রতীকী ছবি

সিজার মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৮:৩৫
Share: Save:

মধ্য রাতে এখানে সত্যিই ফুটপাত বদল হয়।

ভোরের আলো ফুটে বেলা গড়ানোর আগেই ছোট মেয়েকে নিয়ে একটি দোকানে বাসন মাজার কাজে চলে যান তিনি। ফুটপাতের অন্য প্রতিবেশীরাও বেরিয়ে পড়েন রুজির খোঁজে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ফুটপাত চলে যায় ফেরিওয়ালা আর অফিসপাড়ার ব্যস্ত পথচারীদের দখলে। তাঁর ‘সংসার’ তখন কুণ্ডলী পাকানো পোটলার চেহারা নিয়ে ঠাঁই পায় ফুটপাতেরই একটা কোণে! রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটপাত ফাঁকা হলে ফের ‘সংসার’ পাততে ফিরে আসেন ওঁরা। শোওয়ার জায়গা কয়েকটা ভাঙা প্যাকিং বাক্স দিয়ে ঘেরা। কিছুটা শীত আটকাতে, বাকিটা বোধহয় বড় মেয়ের ঘটনাটা ঘটার পর কিছুটা আবডাল তৈরি করতে! নিরাপদ মনে করে মানসিক শান্তি!

তিনি দিশার (নাম পরিবর্তিত) মা। দিশাকে মনে আছে? দিল্লির ‘নির্ভয়া’র থেকে কোনও অংশে কম ভয়ানক ছিল না এই শহরের দিশা-কাণ্ড। কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজার কয়েকশো মিটার দূরে টি-বোর্ডের উল্টো দিকে ব্রাবোর্ন রোডের ওই ফুটপাতে এখনও থাকে দিশার পরিবার। ২০১৬-র ৩১ অগস্ট এই ফুটপাতে রাতের অন্ধকারে মায়ের পাশ থেকে মুখে চাপা দিয়ে ওয়াটগঞ্জ এলাকার দুই অ্যাপ ক্যাব-চালক তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন ১২ বছরের ওই বালিকাকে। এর পর গাড়ির মধ্যেই তার উপর উপুর্যপরি নির্যাতন চালান দু’জন। অপরাধ চাপা দিতে গলা টিপে খুন করে দিশার দেহ ফেলে দেওয়া হয় তপসিয়া এলাকার একটি খালের জলে। ঘটনার তিন বছর পরেও দিশার পরিবারের কাছে বিচার এখনও অধরা।

ফুটপাতই এঁদের ঘর, এঁদের সংসার। প্রতীকী ছবি

বুধবার মধ্য রাতে ওই ফুটপাতে গিয়ে দেখা গেল, সংসার সাজাতে ব্যস্ত দিশার মা। শোওয়ার জায়গা কয়েকটা ভাঙা প্যাকিং বাক্স দিয়ে ঘিরে দিচ্ছেন। মেয়ের মামলার কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি মুখ তুলে রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘‘যা জিজ্ঞাসার আছে, পুলিশকে গিয়ে করুন। আমরা কিছু জানি না।” ফের ভাঙা প্যাকিং বাক্স দিয়ে সংসারকে নিরাপত্তায় মুড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি।

চিৎকার শুনে সঙ্গে সঙ্গে চলে এলেন দিশার মেসো দীপক (নাম পরিবর্তিত)। সাংবাদিক পরিচয় জেনে তিনি বললেন, ‘‘বড় মেয়ের ওই ঘটনার পর থেকেই মাথাটা কেমন হয়ে গিয়েছে ওর। কথাবার্তা ঠিক করে বলে না।” মায়ের পাশেই ভাত খাচ্ছিল বছর দশেকের এক বালিকা, দিশার ছোট বোন। তার দিকে আঙুল দেখিয়ে দিশার মেসো বললেন, ‘‘কী বলব বলুন তো? ছোট মেয়েটাকে নিয়ে এই ফুটপাতেই তো রয়েছি, সেই আতঙ্ক নিয়ে। আবার যে কিছু হবে না, তার কোনও গ্যারান্টি আছে? তাই বলতে ভয় পাই।” খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে ফুটপাতের উপর পড়ে থাকা ভাঙা প্যাকিং বাক্সের উপর বসে দীপক নিজের মনেই বলে ওঠেন, ‘‘বিচার তো আমরা সকলেই চাই। মনেপ্রাণে চাই মেয়েটা বিচার পাক। ফাঁসির সাজা হোক অপরাধীদের। কিন্তু বিচার দেবে কে? তিন বছরের বেশি হয়ে গেল। এখনও তো কিছুই হল না!”

অথচ হেয়ার স্ট্রিট থানার এই মামলায় পুলিশ নির্ধারিত তিন মাস সময়ের অনেক আগেই চার্জশিট জমা দিয়েছিল আদালতে। দুই অভিযুক্ত গুড্ডু সিংহ এবং শঙ্কর সাউয়ের বিরুদ্ধে। পকসো আদালত ২০১৬-র নভেম্বরেই ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৬৪, ৩৭৬এ, ৩৭৬ডি, ৩০২, ২০১, ৩৪ এবং পকসো-র ৪ ও ৬ ধারায় চার্জ গঠন করে। সেই সময় থেকে প্রক্রিয়া চললেও এখনও শেয হয়নি বিচার। এর মধ্যেই গত বছরের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্সি জেলেই মারা যান মামলার অন্যতম অভিযুক্ত গুড্ডু সিংহ। মামলার তদন্তকারী আধিকারিক সুখেন্দু চট্টোপাধ্যায় এখন শেকসপিয়র সরণি থানায় কর্মরত। তিনি বলেন, ‘‘আমরা তো আমাদের যা করার করে দিয়েছি। এখন সরকারি আইনজীবীদের বিষয়।”

নগর দায়রা আদালতের মুখ্য সরকারি আইনজীবী তমাল মুখোপাধ্যায় অবশ্য দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ মানেননি। তিনি বলেন, ‘‘মামলা যথেষ্ট গতিতেই এগোচ্ছে। আমরা খুব ভাল অবস্থানে রয়েছি।”

কিন্তু সেই ‘ভাল অবস্থান’-এর কথা মানতে নারাজ দিশার মেসো দীপক। নিজেদের অগোছালো সংসারের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলছিলেন, ‘‘আমাদের অবস্থা তো দেখছেন। এর পর রোজ রোজ কোর্টে যাওয়া কি সম্ভব? তা-ও শুনেছি কাল ডেট আছে। যাওয়ার চেষ্টা করব। পারব কি না জানি না।” দীপক ঠিকই জানেন, বৃহস্পতিবারও ওই মামলার শুনানি রয়েছে কলকাতা নগর দায়রা আদালতের বিশেষ পকসো (প্রোটেকশন অব চিল্ড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস) আদালতে। দীপক বলছিলেন, ‘‘জানি তো, আরও একটা ডেট পড়বে। কিন্তু কাজের কাজ তো কিছু হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।’’

ওই মামলায় অভিযুক্তদের আইনজীবী হিসেবে যুক্ত ছিলেন এমন এক জন কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ তুলছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই আইনজীবী বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী এ ধরনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার কথা বলছেন। অথচ, এই মামলা তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। এটা যদি দীর্ঘসূত্রতা না হয়, তবে দীর্ঘসূত্রতা কাকে বলে একটু বলবেন?”

নগর দায়রা আদালতের বর্ষীয়ান এক আইনজীবী এই মামলার এত দেরির পিছনে সরকারি কৌঁসুলিদের একটা অংশকে দায়ী করেছেন। তিনি বলছেন, ‘‘পকসো আদালতের জন্য প্যানেলভুক্ত তিন জন সরকারি কৌঁসুলি রয়েছেন। অথচ এই মামলায় সেই আইনজীবীদের বদলে অন্য সরকারি কৌঁসুলি লড়ছেন।” নগর দায়রা আদালতের অন্য এক আইনজীবী সংশয় প্রকাশ করছেন মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাঁর কথায়, ‘‘এখন যে বিচারকের কাছে এই মামলার বিচার চলছে, তিনি দু’মাস পরে অবসর নেবেন। অর্থাৎ নতুন বিচারক দায়িত্ব পাওয়ার পর সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্ব আবার নতুন করে শুরু হবে। তা হলেই বুঝে দেখুন মামলার ভবিষ্যৎ কী!”

নির্ভয়ার মা সম্প্রতি আক্ষেপ করে বলেছেন, সাত বছর কেটে যাওয়ার পরেও বিচার পায়নি তাঁর মেয়ে। নির্ভয়া-মামলায় নিম্ন আদালত অবশ্য ১০ মাসের মধ্যে রায় শুনিয়েছিল। দিশা-মামলায় নিম্ন আদালতে ইতিমধ্যেই কেটে গিয়েছে তিন বছরের বেশি সময়।

মধ্য রাতের ব্রাবোর্ন রোডে ফুটপাত বদলে যায়, কিন্তু বদলায় না দিশার বিচার-ভাগ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE