Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

শূন্যস্থানে মাটির প্রলেপ দিয়েই বাঁচার লড়াই বধূর

বছর তিনেকের শিশুকন্যা কোলে শিল্পীর স্ত্রী তখন বলে দেন, ‘‘ওই আপনাদের ঠাকুর। শিল্পী মারা গিয়েছেন। ঠাকুর এ বার আর হবে না!’’ পাশেই প্লাস্টিকের ছাউনির নীচে তখন দাঁড় করানো প্রথম মাটির প্রলেপ পড়া সেই প্রতিমার কাঠামো!

জীবনযুদ্ধ: প্রতিমা তৈরির কাজে ব্যস্ত চুমকি পাল। ছবি: তাপস ঘোষ

জীবনযুদ্ধ: প্রতিমা তৈরির কাজে ব্যস্ত চুমকি পাল। ছবি: তাপস ঘোষ

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:৫২
Share: Save:

বায়না দেওয়ার পরে প্রতিমা কত ফুট লম্বা আর কতটা চওড়া হবে, শুধু সেই মাপটুকুই বলা ছিল শিল্পীকে। থিমের সঙ্গে মিলিয়ে মণ্ডপের রং চূড়ান্ত হওয়ার পরে হবে বাকি কথা। গত শুক্রবার সেই মতো চন্দননগরের ডুপ্লেপট্টির কুমোরপাড়ায় গিয়ে শিল্পীকে আর থিমের সঙ্গে মানানসই প্রতিমা সম্পর্কে বোঝাতে পারেননি মুদিয়ালি ক্লাবের পুজো উদ্যোক্তারা।

বছর তিনেকের শিশুকন্যা কোলে শিল্পীর স্ত্রী তখন বলে দেন, ‘‘ওই আপনাদের ঠাকুর। শিল্পী মারা গিয়েছেন। ঠাকুর এ বার আর হবে না!’’ পাশেই প্লাস্টিকের ছাউনির নীচে তখন দাঁড় করানো প্রথম মাটির প্রলেপ পড়া সেই প্রতিমার কাঠামো!

শুধু ওই পুজোর উদ্যোক্তারাই নন, গত বুধবার চন্দননগরের মৃৎশিল্পী অমিত পালের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে সমস্যায় পড়েছে শহরের বেশ কয়েকটি পুজো কমিটি। তাদের মধ্যে বেহালা ও কুঁদঘাট এলাকার বেশ কয়েকটি বড় পুজোও রয়েছে। ভাইয়ের মৃত্যুর পরে প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ করার দায়িত্ব নিয়েছেন মৃতের দাদা, পেশায় মৃৎশিল্পী অসিত পাল। প্রতিমা গড়ার কাজে এখন সঙ্গী হয়েছেন মৃতের স্ত্রী চুমকি পালও। অসিত বলেন, ‘‘আমার নিজের ১০টা প্রতিমার বরাত রয়েছে। তার মধ্যে এই ঘটনা ঘটল। পুজোর আর এক মাস বাকি। উদ্যোক্তারাই বা যাবেন কোথায়! ভাই আর আমার মিলিয়ে মোট ১৯টা ঠাকুর আমাদের শেষ করতে হবে এ বার।’’ কয়েক মিনিট থেমেই অসিত এর পরে বললেন, ‘‘ভাই হয়তো অনেক আগেই সব ঠিক করে নিয়েছিল। দিন দু’য়েক আগেই একটা প্রতিমার বরাত অন্য এক শিল্পীকে দিয়ে দিয়েছিল।’’

অসিত জানান, বাবা-ঠাকুরদার প্রতিমা নির্মাণ ব্যবসায় তাঁরা দুই ভাই যোগ দেন প্রায় ২০ বছর আগে। বাবার মৃত্যুর পরে তাঁর মা, বছর সত্তরের কেয়া পাল ভাই অমিতের সঙ্গেই থাকতেন। স্ত্রী ছাড়াও অমিতের একটি পাঁচ বছরের এবং একটি তিন বছরের মেয়ে রয়েছে। স্ত্রী ও নিজের দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে অসিত অন্যত্র থাকেন। তিনি বললেন, ‘‘গত কয়েক দিন ধরেই ভাই কেমন একটা মন খারাপ করে থাকত। তবে পুজোর আগে অনেক বেশি করে বরাত নিতে চাইছিল। ন’টা ঠাকুরের বরাত পেয়েও বলছিল, আরও কয়েকটা পেলে ভাল হয়। অনেক সময়ে অনেক টাকা বাকি থাকে।’’

তবে বুধবারের ভোরবেলাটা তাঁদের সব কিছু বদলে দিয়েছে বলে দাবি অসিতের। বললেন, ‘‘সকালে মা হঠাৎ ঘুম থেকে ডেকে তোলেন আমাকে। সারা রাত ভাই মুদিয়ালির ঠাকুরটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ভোরে বাড়ির পাশের একটি গাছ থেকে ভাইয়ের দেহটা ঝুলতে দেখা যায়।’’ চন্দননগরের স্থানীয় থানার পুলিশ গিয়ে দেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। রুজু হয় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা।

স্বামীর অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে ভাসুরের সঙ্গে হাত লাগানো চুমকির এখন সময় কাটছে কাঠামোয় মাটির প্রলেপ লাগিয়ে। সঙ্গে দুই শিশুকন্যার পরিচর্যা। তার মধ্যেই বললেন, ‘‘আমার দু’টো মেয়েই খুব ছোট। ঠাকুর বানাতে শিখিনি কখনও। তবে চেষ্টা করছি। আর তো কিছু রইল না! মেয়ে দু’টোকে মানুষ করতে হবে।’’ কথায় কথায় গলা বুজে আসে মহিলার। পুজো উদ্যোক্তাদের অবশ্য বিশ্বাস, ‘‘কাজ ঠিক নামিয়ে দেবেন ওঁরা।’’

তাঁরা বরং মুগ্ধ মহালয়ার আগে আরও এক ‘দেবী’র গল্পে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Idol Mudiali Club Woman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE