Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

‘পুড়ে গিয়েছে সব, তবু হাল ছাড়ব না’

সোমবার দুপুরে এমন অনিশ্চয়তার মুখেই পড়তে হল জগৎপুর আদর্শ বিদ্যামন্দিরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মিতালি হালদারকে। তার বাড়ি নিউ টাউনের থানা এলাকার সুলংগুড়ির দক্ষিণপাড়ায়। বাবা জীবনকৃষ্ণ হালদার দিনমজুর। মা দেবী হালদারও কাজ করেন।

পুড়ে গিয়েছে বই-সহ বাড়ির সব জিনিস। ধ্বংসস্তূপে মিতালি। সোমবার, সুলংগুড়িতে। ছবি: শৌভিক দে

পুড়ে গিয়েছে বই-সহ বাড়ির সব জিনিস। ধ্বংসস্তূপে মিতালি। সোমবার, সুলংগুড়িতে। ছবি: শৌভিক দে

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৮ ০৩:১২
Share: Save:

মাধ্যমিকের প্রথম দিনটা ভাল ভাবেই পার করেছিল মিতালি। আনন্দেই বাড়ি ফিরছিল। কিন্তু কে জানত, আরও কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে তার জন্য।

সোমবার বাংলা পরীক্ষা দিয়ে বাগুইআটির অশ্বিনীনগরের পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফেরার সময়েই বেজে ওঠে ফোন। মুখটা হঠাৎ কঠিন হয়ে যায় মায়ের। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে জল। মিতালি জানল, হঠাৎ আগুনে পুড়ে ছাই তাদের ঘর।

পাড়ায় পৌঁছেই দেখল সে, ঘরের জায়গায় পড়ে ছাইয়ের গাদা। পড়ে শুধু কয়েকটি মাত্র বাঁশ। চোখের জল ফেলার সময়ে নেই। রাত পোহালেই ইংরেজি পরীক্ষা। কিন্তু সে ঘরেই যে ছিল বাকি পরীক্ষার বই-খাতা, স্কুলের ডায়েরি থেকে পড়াশোনার যাবতীয় জিনিস।

সোমবার দুপুরে এমন অনিশ্চয়তার মুখেই পড়তে হল জগৎপুর আদর্শ বিদ্যামন্দিরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মিতালি হালদারকে। তার বাড়ি নিউ টাউনের থানা এলাকার সুলংগুড়ির দক্ষিণপাড়ায়। বাবা জীবনকৃষ্ণ হালদার দিনমজুর। মা দেবী হালদারও কাজ করেন। দু’জনের মিলিত যৎসামান্য উপার্জনে দক্ষিণপাড়ায় একটি পুকুরের ধারে বাঁশ, বেতের ঘর তৈরি হয়েছিল বছর খানেক আগে। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, এ দিন দুপুর বারোটা নাগাদ সেই ঘরেই আগুন লাগে। আচমকা ধোঁয়া দেখে ছুটে এসে বালতি করে জল দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেন প্রতিবেশীরা। আগুন প্রথমে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ঘরে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে গিয়ে আগুন আরও দ্রুত ছড়ায়। আগুনের আতঙ্কে ঘরের ধারে কাছে পৌঁছতে পারছিলেন না বাসিন্দারা। তবুও চেষ্টা ছাড়েননি তাঁরা। অভিযোগ, দমকলের একটি গাড়ি যত ক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় তত ক্ষণে সব শেষ। দমকলের অনুমান, শর্ট সার্কিটের জেরেই আগুন লাগে।

মিতালিরা কেউ বাড়িতে ছিল না তখন। ফিরে দেখে, বইখাতা থেকে আলমারি, খাট, পোশাক— সব আগুনে পুড়ে ছাই। একটি বাঁশের সাঁকো দিয়ে পুকুর পাড়ের ওই ঘর থেকে যাতায়াত করত ওই পরিবার। পুড়ে গিয়েছে সেটিও। এ দিন পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দেবী হালদার বলেন, ‘‘ঘরে পাঁচ হাজার টাকা কোনও মতে জমিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম মেয়েটা পরীক্ষা দিচ্ছে, কখন কী কাজে লাগে। সেই টাকাও পুড়ে গিয়েছে। কী ভাবে যে ঘুরে দাঁড়াব, ভাবতেই পারছি না।’’

ভেঙে পড়েছেন জীবনবাবুও। তিনি বলেন, ‘‘আমার একটি অপারেশন হয়েছে। ভারী জিনিস তুলতে পারি না। তাই রোজগারও কম হয়। কোনও মতে ঘরটা তুলেছিলাম। এ বার কী করব, জানি না। কিছুই ভাবতে পারছি না।’’

কিন্তু বাবা-মায়ের থেকেও পড়শিদের এখন ভাবনা মিতালিকে নিয়ে। পাড়ার মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। তা যেন কোনও ভাবেই আটকে না যায়, সে চেষ্টায় গোটা পাড়া। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বিধাননগর পুলিশ প্রশাসন এবং জ্যাংড়া হাতিয়াড়া ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতও। বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত বলেন, ‘‘সব শুনেছি। পঞ্চায়েত প্রধানকে বলেছি, দ্রুত ব্যবস্থা নিতে। আমরা ওই পরিবারের পাশে আছি।’’ এ দিনই মিতালির জন্য পড়ার বই দেওয়া হয়েছে পঞ্চায়েত প্রধান শিবু গায়েন এবং বিধাননগর পুলিশের তরফে। তাতে সাহায্য হলেও সবটা যে নতুন বইতে নেই। এত দিন খেটে তৈরি করা নোটের খাতা ছাড়া ইংরেজি পরীক্ষাটা যে কী করে হবে, ভাবলেই চিন্তা হচ্ছে মিতালির।

শুভ হাজরা নামে এক পড়শির বাড়িতে থাকবে আপাতত মিতালিরা। পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন জয়দেব হালদার, রবীন্দ্রনাথ টিকাদার থেকে শুরু করে গোটা পাড়ার বাসিন্দারা। তাঁরাই জানান, জীবনকৃষ্ণ-দেবী হালদারের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে টুম্পার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট মেয়ে মিতালিকে নিয়ে শুধু তাঁদের নয়, গোটা পাড়ার আশা। মাধ্যমিকে ভাল ফল করে গোটা এলাকার মুখ উজ্জ্বল করবে মিতালি।

এখন অবশ্য গোটা ঘটনায় আকস্মিকতায় একেবারে নিশ্চুপ মিতালি। আচমকা এমন বিপর্যয়ে এ বার সে কী করবে সে? মিতালি বলে, ‘‘আজ, বাংলা পরীক্ষা ভাল হয়েছে। ভাল প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সব পরীক্ষাই ভাল হবে। কিন্তু সবই যে পুড়ে গিয়েছে। তবে হাল ছাড়ব না। চেষ্টা করবই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE