আঁকড়ে: কালীঘাটের গ্রিক অর্থোডক্স চার্চে সন্ন্যাসিনী। ছবি: সুমন বল্লভ।
‘ড’কে ‘দ’ আর ‘ট’কে ‘ত’ বলেন, ৬৬ বছরের কর্তৃত্বশালী বৃদ্ধা। গ্রিক টানের ইংরেজির মধ্যে এতদিনে দু’চারটে বাংলা বাক্যও গুঁজে দিতে শিখেছেন সিস্টার নেকতারিয়া পারাদিসি।
এ শহরের ইতিহাসের একটা বিস্মৃত অধ্যায় আর কাঠখোট্টা সমকালের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকেন কালো পোশাক পরা ছোট্টখাট্টো সন্ন্যাসিনী। কালীঘাট ট্রাম ডিপোর পাশে সাদা ধবধবে স্থাপত্যের আনাচকানাচে পরম মমতায় যাঁর দু’চোখ ঘোরাফেরা করে। হেরিটেজ-তকমাধারী এই বাড়িটিই কলকাতার গ্রিক অর্থোডক্স গির্জা।
সূদূর ইতিহাসের বাইজ্যান্টাইন সভ্যতা, কবে কার কনস্তান্তিনোপ্ল কিংবা ইস্তানবুল শুধু নয়, একদা এ শহরে ভাগ্যান্বেষণে আসা গ্রিক সমাজের সঙ্গে কলকাতার যোগসূত্র ওই বৃদ্ধার জিম্মায় রাখা।
কেজো দুপুরে নাগরিক কলরোল ভেসে আসে গির্জার প্রকাণ্ড ঘরটায়। আর গির্জার অভিভাবক সিস্টারের মৃদু স্বর সিলিংয়ের কয়েকটি চাঙড় খসে পড়া অংশের জন্য উতলা হয়ে ওঠে। বাড়িটির খেয়াল রাখে দিল্লির গ্রিক দূতাবাসও। গির্জার আধ্যাত্মিক শিকড় ইস্তানবুলে গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের সদরে। রাজপথের মুখোমুখি গ্রিক ফলক বলছে, হেস্টিংসের আমলে বড়বাজারের কাছের আমড়াতলা স্ট্রিটে এ শহরে গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের প্রথম গির্জাটি গড়ে উঠেছিল। তা এখন নেই। এই বাড়িটি, তুলনায় তরুণ। পঞ্চম জর্জ বিলেতের রাজা থাকাকালীন ১৯২৪ সালে তৈরি।
তবে এ গির্জার গল্প, প্রায় ফিনিক্স পাখির মতো। ব্যবসা করতে একদা ‘প্রাচ্যের লন্ডন’-এ আসা গ্রিকরা কলকাতা ছাড়ছিলেন, ১৯৪৭ থেকেই। গ্রিক শূন্য কলকাতায় ১৯৭২ নাগাদ গির্জা বন্ধই হয়ে যায়। ক্রমশ লাগোয়া রাস্তা জুড়ে হকাররাজ আর গির্জা-চত্বরে জঙ্গল-আগাছায় গাঁজাক্ষেত্র গড়ে উঠেছিল। শহরের ইতিহাসের একটা অধ্যায় যেন চাপাই পড়ে যাচ্ছিল। ৯০-এর দশকে ধবংসস্তূপ থেকে উড়ান-পর্ব। তৎকালীন গ্রিক ফাদার ইগনেশিওস সেনিস হাল ধরলেন। দেশ-বিদেশের পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়িটির হাল ফিরেছে। প্রাক্তন গ্রিক প্রেসিডেন্ট স্তেফানোপুলোস, প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপানদ্রু কিংবা কনস্তান্তিনোপ্লের আর্চবিশপ বার্থলোমিউয়ের মতো মান্যগণ্যরাও এ গির্জায় ঢুকেছেন। বছর দশেক হল, মাদাগাস্কারের বিশপ হয়ে কলকাতা ছেড়েছেন ফাদার। ২৫ বছর আগে কলকাতায় আসা সিস্টার পারাদিসির কাঁধে সবকিছুর ভার।
সন্ন্যাসিনী অবশ্য থাকেন, কবরডাঙা পেরিয়ে বাঁকেশ্বরে। তাঁর হাতে গড়া অনাথ আশ্রমের দেড়শো ছেলেমেয়ের তিনি মা। তবে দেশবিদেশের অতিথিরা এলে সিস্টারকে কালীঘাটে আসতেই হয়। গির্জার রক্ষণাবেক্ষণে দেশ-বিদেশে চিঠিপত্র লেখা থেকে ফি-দুপুরে এ তল্লাটের শ’খানেক দরিদ্র ভোজনের খেয়ালখবরও তাঁর দায়িত্ব। কলকাতায় সিস্টারের গোড়ার দিনগুলো থেকে সহযোগী, খ্রিস্টোদুলাল প্রেমাঙ্কুর বিশ্বাস সহাস্যে বলেন, কলকাতার এক ‘গ্রিক পুনরুত্থান’-এর গল্প।
তিন পুরুষের প্রোটেস্ট্যান্ট প্রেমাঙ্কুর গ্রিক অর্থোডক্স গির্জায় দীক্ষা নিয়েছেন। খাঁটি গ্রিকরা না-থাকলেও বাঙালি খ্রিস্টান সমাজের কেউ কেউ একই পথের পথিক। কলকাতা, হুগলি, মেদিনীপুরের কিছু চ্যাপেল মিলিয়ে এ দেশে এই গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ-সংযোগ সম্ভবত শুধু বাংলায় মিলবে।
গ্রিক লিপি খচিত গির্জায় রবিবাসরীয় উপাসনাও হয় বাংলায়। ফাদার অ্যান্ড্রু মণ্ডল, শম্ভু মাইতিদের সুরে জনা ৫০ ভক্ত সমস্বরে বলেন, ‘পবিত্র ঈশ্বর, পবিত্র পরাক্রম, পবিত্র অমৃত আমাদের প্রতি দয়া করো’!
এ সবের নেপথ্যে থাকে, কালো পোশাক পরা সন্ন্যাসিনীর অনুচ্চ অবয়ব। প্রার্থনা ঘরে সোনা-রুপোর সাজের যিশু-মেরির ‘ইকোনা’ (আইকন বা প্রতীক) বা চতুর্থ শতকের শহিদ খ্রিস্টান সন্ত ক্যাথারিনের ছবির সামনে হাঁটতে হাঁটতে সিস্টার পারাদিসি বলেন, ‘‘চুপচাপ প্রার্থনার আর একটু সময় পেলে ভাল হত। কলকাতায় কম কাজ আমার!’’ ক’বছর আগে করিন্থে মা মারা যাওয়ার পরে গ্রিসে পিছুটান ঘুচেই গিয়েছে সিস্টারের।
ভিন্ শহরের গরিব দুঃখী ছেলেমেয়ে আর গির্জার সংসারের জোয়ালটাই তাঁর সব। সাবেক স্থাপত্যের ঘেরাটোপে বৃদ্ধার আদরে জেগে থাকে কলকাতার ভেতরের এক টুকরো গ্রিস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy