তামাক বিক্রেতা ডি ম্যাক্রোপোলোর পোস্টকার্ড, ছাপা হয়েছিল ইতালিতে - নিজস্ব চিত্র
শেষ কবে কাউকে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছেন? এমন প্রশ্ন করলে, মাথা চুলকাতে হবে।
এ যুগে তো পোস্টকার্ড বিলুপ্তপ্রায় এক সভ্যতার নিদর্শনমাত্র। তবে খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, একশো-দেড়শো বছর আগেও এই পোস্টকার্ড ছিল সে সময়ের ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম। কোনও জায়গার ছবি ছাপানো পোস্টকার্ডে শুভেচ্ছা বিনিময় বা খোঁজখবর নেওয়াটা ছিল দস্তুর। তাই এ দেশ থেকে পাঠানো কোনও পোস্টকার্ড যখন সাত সাগর পেরিয়ে আমেরিকায় শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে পৌঁছত, তখন শুধু বার্তা নয়, হাজার হাজার মাইল দূরের দেশটায় ফুটে উঠত ঔপনিবেশিক ভারতের জনজীবনের ছবিটাও।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইউরোপ-আমেরিকায় পোস্টকার্ডের ব্যবসা চলছিল রমরমিয়ে। ইতিহাসবিদ ওমর খানের মতে বার্ষিক পোস্টকার্ড ছাপানোর সংখ্যাটা ছিল ২০০ কোটির মতো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল যে কলকাতা, সেই শহরেও তখন ফুলে ফেঁপে উঠেছিল এই পোস্টকার্ডের ব্যবসা। সোমবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের পূর্বপ্রান্তে লর্ড কর্নওয়ালিস, থুড়ি তাঁর মার্বেল মূর্তির সজাগ দৃষ্টিতে সেই হারিয়ে যাওয়া দিনের গল্প শোনালেন পাকিস্তানি ইতিহাসবিদ ওমর।
সালটা ১৮৯৭। সে সময়ের পোস্টকার্ডে ক্লাইভ স্ট্রিট বা থিয়েটার রোড যে ভাবে ধরা দেয়, দেখলে এক টুকরো ইউরোপ বলে ভুল হতে পারে। উনিশ শতকের একেবারে শেষ দিক থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কলকাতায় রমরমা ছিল এই বাহারি পোস্টকার্ডের। মদ বা সিগারেটের সারোগেট বিজ্ঞাপন হিসেবে এখন গানের সিডি বা বাহারি উপহারের চল রয়েছে। সে সময়ে কলকাতার বিখ্যাত তামাক বিক্রেতা ডি ম্যাক্রোপোলা কিংবা ইতালীয় ওয়াইন কোম্পানি ফেরুজিনোসো সেরাভালো ক্রেতাদের উপহার দিতেন কলকাতার ছবিওয়ালা বাহারি পোস্টকার্ড। পোস্টকার্ড ব্যবসায় লাভের হাতছানি পেয়ে সে সময়ের অনেক বিখ্যাত চিত্রগ্রাহকও এই ব্যবসায় নামেন। ওয়ার্নার রোসলার, জনস্টন অ্যান্ড হফম্যান ছিলেন যার অন্যতম। লন্ডনের ‘রাফায়েল টাক অ্যান্ড সন্স’ কিংবা ‘থ্যাকার স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি’র তৈরি কলকাতা তথা ঔপনিবেশিক ভারতের ছবিওয়ালা পোস্টকার্ডও দারুণ জনপ্রিয় হয়।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের ঘ্রাণ পেতে মোগলমারি আর কুরুম্বীরা ফোর্ট
আরও পড়ুন: ইস্ট-ওয়েস্ট সুড়ঙ্গ ফের বাধা পেল এক স্তম্ভে
রাজভবন, পুরনো বন্দর, চৌরঙ্গী, ডালহৌসি স্কোয়্যার, গ্র্যান্ড হোটেল, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল, রেস কোর্স থেকে কলকাতার বাবু কালচার, কুলি, কামার, সাপুড়ে কী নেই সেই সব পোস্টকার্ডে। দার্জিলঙের ছবিওলা অসংখ্য পোস্টকার্ডেরও দেখা মেলে। এ সব পোস্টকার্ডের দাম ছিল এক আনা, দু’আনা। কী প্রযুক্তিতে পোস্টকার্ড ছাপা হচ্ছে, ছবির মাপ ও রঙের উপর নির্ভর করত পোস্টকার্ডের দাম। সে সময় মহিলারা ছিলেন পোস্টকার্ডের সবচেয়ে বড় সংগ্রাহক। পুরুষদের যত না পোস্টকার্ড পাঠানো হত, তার চেয়ে ঢের বেশি পোস্টকার্ড পেতেন মহিলারা। কোনও মহিলার কাছে বেশি পোস্টকার্ড থাকা মানে তার সৌন্দর্যের কদর তত বেশি। ঠিক ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে লাইক আর ফলোয়ারের সংখ্যার মতোই। কখনও কখনও পোস্টকার্ডে কিছুই লেখা থাকত না, কোন জায়গায় স্ট্যাম্পের ছাপ রয়েছে সেটাই নাকি ছিল সঙ্কেত। অনেক ক্ষেত্রে প্রেম নিবেদনও হত সে ভাবেই।
কী ভাবে পোস্টকার্ডগুলি ছাপা হত, সেই গল্পও চমকপ্রদ।
মূলত পোস্টকার্ডগুলি ছাপা হত ইউরোপে। চিত্রগ্রাহকের তোলা ছবি পাঠানো হত ইউরোপের ছাপাখানায়। লিথোগ্রাফে খোদাই করা হত সেই ছবি। তার পর লিথোগ্রাফে মনোমত রং লাগিয়ে ছাপা হত পোস্টকার্ড। খরচ বাঁচাতেই পরবর্তী সময়ে বদল এসেছে পোস্টকার্ড ছাপার প্রযুক্তিতেও। শুধু নাগরিক জীবনের গল্প বলাই নয় অনেক ক্ষেত্রেই প্রোপাগান্ডার অন্যতম অস্ত্র ছিল এই পোস্টকার্ড। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যে প্রোপাগান্ডা কখনও চালিয়েছে জার্মানি কখনও বা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্ফুলিঙ্গ জুগিয়েছে এই চার কোণা কাগজের টুকরো। তাই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, রবি ঠাকুরের ছবিওয়ালা পোস্টকার্ডও খুঁজে পাওয়া যায়।
সে সময়ের নগরজীবন যেমন বদলে গেছে, তেমনই যে ছবি থেকে এই সব পোস্টকার্ড ছাপা হয়, সে ছবিও কিছু আছে, কিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু হারানো সময়ের স্মৃতি জড়িয়ে রয়ে গেছে হাজার হাজার পোস্টকার্ড।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy