সহকর্মী যদি এইচআইভি পজিটিভ হয়ে থাকেন, দিনের পর দিন তাঁর পাশাপাশি বসে কাজ করলে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
এইচআইভি পজিটিভ কোনও ব্যক্তির সঙ্গে ‘হ্যান্ডশেক’ করলে রোগ ছড়ানোর ভয় রয়েছে।
এইচআইভি পজিটিভ রোগীকে ছুঁয়ে পরীক্ষা করলেও তাঁর থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি প্রবল।
রোগীর আত্মীয়-প্রতিবেশী নন, এমন ধারণা এখনও আঁকড়ে বসে রয়েছেন অন্তত তিন বছর পেশায় থাকা খাস সরকারি হাসপাতালের নার্সদেরই একাংশ। এত বছর ধরে এড্স-সচেতনতায় এত প্রচার চালানোর পরে এমনই ছবি উঠে এল সরকারি চিকিৎসকদের করা এক সমীক্ষায়।
একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নালে সম্প্রতি সমীক্ষাপত্রটি প্রকাশিত হতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এইচআইভি সংক্রমণ যখন গোটা বিশ্বেই অন্যতম বড় সমস্যা, তখন রাজ্যের চিকিৎসা পরিষেবায় সরাসরি যুক্ত নার্সদের মধ্যে সংক্রমণের প্রাথমিক তথ্য সম্পর্কে এমন অজ্ঞতা কেন? কেনই বা তাঁদের সচেতন করতে যথাযথ পদক্ষেপ করছে না স্বাস্থ্য দফতর ?
মেডিক্যাল কলেজগুলিতেই যেখানে সচেতনতার এই বহর, সেখানে অন্য হাসপাতালগুলির ছবিটা কেমন? অজ্ঞতার কারণে বেশির ভাগ জায়গাতেই এইচআইভি পজিটিভদের একঘরে করে রাখা হয়। বহু ক্ষেত্রে হাসপাতালেও তাঁরা যথাযথ চিকিৎসা পান না। দিনের পর দিন তা জেনেও স্বাস্থ্য দফতর ব্যবস্থা নেয় না কেন?
সমীক্ষার ফলাফলের খবর পেয়ে অস্বস্তিতে স্বাস্থ্যকর্তারাও। এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘এইচআইভি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে দেদার অর্থসাহায্য আসে। কিন্তু তার ব্যবহার যে যথাযথ হয় না, সমীক্ষাই তা বলছে। এখনই সাবধান না হলে দুর্ভোগ বাড়বে।’’
সমীক্ষক দলে ছিলেন এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অ্যানাটমি বিভাগের চিকিৎসক পাঞ্চালি সোম, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক মধুমিতা বসু, কলকাতা পুরসভার চিকিৎসক ঋতুপর্ণা গুহ এবং বিহারের কিষেণগঞ্জের এমজিএম মেডিক্যাল কলেজের রেডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক সুমিত দত্ত। সার্জারি, গাইনি, মেডিসিন এবং পেডিয়াট্রিক বিভাগে কর্মরত ২৫-৩৫ বছর বয়সী যে নার্সদের সঙ্গে কথা বলা হয়, তাঁদের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা তিন বছর। এইচআইভি কী ভাবে সংক্রমিত হয়, জানতে চাইলে ওই নার্সদের অধিকাংশই যৌন সংসর্গের কথা বলেছেন। রক্ত নিতে গিয়ে সংক্রমণের শিকার হওয়ার ঝুঁকির কথাও জানেন না অনেকেই। জানেন না যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া বা দ্রুত ওজন কমতে থাকা লোকেদের এইচআইভি পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া কতটা জরুরি। এমনকী, নিজেদের সুরক্ষা নিয়েও সচেতনতা যথেষ্ট কম। এইচআইভি পজিটিভ কাউকে পরীক্ষার সময়ে অ্যাপ্রন, গ্লাভস, মাস্ক, বিশেষ চশমা, সব শেষে হাত ধোয়া কেন জরুরি, সেটাও বলতে পারেননি বহু নার্স।
অন্যতম সমীক্ষক শর্মিষ্ঠাদেবী জানান, সচেতনতার এমন অভাব সত্যিই বিস্ময়কর। এইচআইভি পজিটিভ মায়েরা স্তন্যপান করাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে নার্সদের একটা বড় অংশের ধারণাই ভুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এইচআইভি পজিটিভ মায়েদের সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সুপারিশ করেছে।
কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারও বলেন, ‘‘এই সময়ে দাঁড়িয়ে অজ্ঞতার এমন ছবি দুর্ভাগ্যের। বুঝতে হবে, রোগিণীর বুকের দুধ সব ক্ষেত্রে ক্ষতিকর নয়। কিন্তু কখনও বুকের দুধ, কখনও কৌটোর দুধ— এই ‘মিক্সড ফিডিং-এর প্রবণতা এইচআইভি সংক্রমণের ক্ষেত্রে মারাত্মক। অনেকেরই সেই ধারণা নেই।’’
এইচআইভি পজিটিভদের নিয়ে কাজ করা এক সংগঠনের তরফে ক্ষিতীশ মণ্ডল বলেন, ‘‘ডাক্তারদের একটা বড় অংশের অবস্থাও এর চেয়ে আলাদা কিছু নয়। সেই কারণেই হাসপাতালে এইচআইভি পজিটিভ মানুষেরা এমন বৈষম্যের শিকার হন।’’
নার্সদের একটি সংগঠনের তরফে পার্বতী পালের কথায়, ‘‘আরও বেশি করে প্রশিক্ষণ দরকার। নিজেদের বাঁচাতে, অন্যকে বাঁচাতে এবং চিকিৎসার বৈষম্য দূর করতে তা জরুরি। শুধু নার্সদের দোষী না করে এইচআইভি পজিটিভদের অস্ত্রোপচারের সময়ে চিকিৎসক-নার্সদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা কিট-এর সরবরাহও নিয়মিত থাকাটা জরুরি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy