অক্ষত: ৩৬, বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের বাড়িতে তাঁর পূর্ণাবয়ব মূর্তি। বুধবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
কেউ বসে আছেন কি?
আলো থেকে প্রায়ান্ধকার ঘরে ঢুকে প্রথমেই চমক লাগে।
কেউ কি বসে আছেন? তিনিও দেখছেন সব!
সামনে টেবিল। তার উপরে তিনটি বই রাখা। যিনি বসে আছেন, তাঁর হাতেও বই। চেয়ারের উপরে বসে সেখান থেকেই যেন তিনি নির্মোহ ভাবে দেখছেন সব। টানটান, ঋজু শিরদাঁড়া। যেমনটা আজীবন থেকেছেন।
‘‘যারা এ কাজটা করল, তারা কি বর্ণপরিচয় পড়েনি? বর্ণপরিচয় পড়লে এ কাজ কি করা যায়?’’, বলছিলেন জগদীশচন্দ্র রায়। ৩৬, বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের কেয়ারটেকার। ওই বাড়িতেই বিদ্যাসাগর জীবনের শেষ ১৪ বছর কাটিয়েছিলেন। সেই বাড়িতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
বাড়িটির দোতলার একটি ঘরে এখন তাঁর পূর্ণাবয়ব একটি মূর্তি রয়েছে। বাইরে থেকে যে ঘরে ঢুকলে প্রথমেই চোখে ধাঁধা লাগে, কেউ কি বসে আছেন? ষাটোর্ধ্ব জগদীশবাবু গত চার মাস হল বাড়িটির কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পেয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে যখন প্রথম বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার খবর পান, তখন প্রথমেই তাঁর মনে চিন্তা হয়েছিল, মূর্তি ধ্বংসকারীরা আবার এখানে হামলা চালাবে না তো! জগদীশবাবুর স্বগতোক্তি, ‘‘তিনি তো মানুষকে ভালবাসতেন। কিন্তু সে জন্য তো তাঁর প্রতিবাদ থেমে থাকেনি। আর আজকে তাঁকে নিজেরই মূর্তি ভাঙা দেখতে হল!’’
যে বাড়ির দোতলার ঘরে দাঁড়িয়ে জগদীশবাবু কথাগুলো বলছিলেন, সেই বাড়িটি ১৮৭৬ সালে তৈরি করেছিলেন বিদ্যাসাগর। বাড়িতে গৃহপ্রবেশ করেছিলেন ১৮৭৭ সালের জানুয়ারিতে। এমনটাই জানাচ্ছে ইতিহাসের একটি সূত্র। কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিক জানাচ্ছেন, বাড়িটি তৈরি করতে বিদ্যাসাগরের নিজস্ব কোনও অভিপ্রায় ছিল না। কিন্তু তাঁর সংগ্রহে সংস্কৃত, ইংরেজি, হিন্দি, ফার্সি-সহ প্রায় ১৬ হাজার বই ছিল। গড়ে উঠেছিল নিজস্ব গ্রন্থাগার। হরিপদবাবু বলছেন, ‘‘মূলত ওই বইগুলি রাখার জন্যই বিদ্যাসাগর বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন।’’
ওই বাড়িতেই বর্তমানে ‘ইন্দিরা গাঁধী রাষ্ট্রীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’-এর স্টাডি সেন্টার রয়েছে। নীচে স্টাডি সেন্টারের পঠনপাঠন হয়। উপরের দোতলার ঘর জুড়ে রয়েছেন বিদ্যাসাগর। ঘরের দেওয়াল জোড়া বিদ্যাসাগরের বংশলতিকা, জন্মকাহিনী, কলকাতায় বিদ্যাসাগরের থাকা সংক্রান্ত ঘটনাবলী, তাঁর ছাত্রজীবন, কর্মজীবন-সহ বিবিধ তথ্য বড় বড় বোর্ড করে রাখা রয়েছে। যেমন ভাবে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলেই তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে আটটি হাতে আঁকা ছবি রয়েছে। কোনও ছবির নীচে লেখা, ‘এমানসিপেশন অব উইমেন’, কোথাও লেখা, ‘কমপাইলেশন অব বর্ণপরিচয়’ ইত্যাদি।
ভগ্নাংশ: বিদ্যাসাগর কলেজ চত্বরে পড়ে রয়েছে ভাঙা মূর্তির একাংশ। বুধবার। নিজস্ব চিত্র
ওই স্টাডি সেন্টারের কো-অর্ডিনেটর অসিত রায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। সত্তরোর্ধ্ব অসিতবাবু বলছিলেন, ‘‘এ যে কী রাজনীতি শুরু হয়েছে দেশে! এই রাজনীতির সরল কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে না!’’ অসিতবাবু জানালেন, এক সময়ে বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ২০০০ সালে সেটি সংস্কার করে পুনরুদ্ধার করা হয়। বর্তমানে এখানে বিদ্যাসাগর গবেষণা চর্চা কেন্দ্র তৈরির কথা হচ্ছে।
ইতিহাসের পরিহাস বোধহয় একেই বলে, বলছেন অনেকে। এক দিকে গড়ার কাজ চলছে, অন্য দিকে, ভাঙার! বর্তমানে বাড়িটি যে শিক্ষাকেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে, সেই বিদ্যাসাগর কলেজ ফর উইমেনের অধ্যক্ষা রূপালী চৌধুরী অবশ্য এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
গত তিন মাস ধরে বাড়িটিতে সাধারণের প্রবেশ বন্ধ রয়েছে, বলছিলেন অসিতবাবু। কারণ, বাড়িটিতে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হচ্ছে। তবে খোলা থাকলেও যে খুব ভিড় হয়, একদমই তা নয়। অসিতবাবুর কথায়, ‘‘যাঁরা জানেন, যাঁদের কৌতূহল রয়েছে, তাঁরা আসেন এখনও। কিন্তু সেই সংখ্যাটা দ্রুত কমে যাচ্ছে।’’
তাঁকে নিয়ে কৌতূহল কমছে। কিন্তু তাতে কী! ‘আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি; নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব। লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না।’— তিনি তো বরাবর এই নীতিতেই বিশ্বাসী। তাই মঙ্গলবার রাতে যখন একদল উন্মত্ত মানুষ তাঁর মূর্তি ভাঙছে, তখন বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের দোতলার ওই ঘরে বসে নির্মোহ ভাবে, টানটান ঋজু মেরুদণ্ড নিয়ে যেন সমস্ত কিছু দেখেছেন বিদ্যাসাগর। আর মনে মনে হয়তো বলেছেন,—‘লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy