ঠিকাদার নির্মাণসংস্থা তো বটেই। পোস্তায় আধা তৈরি উড়ালপুল ধসে যাওয়ার ঘটনায় তদন্তকারীদের আতসকাচের তলায় চলে এল খোদ কেএমডিএ-ও। তারই মধ্যে গ্রেফতার হলেন ঠিকাদার সংস্থার আরও চার কর্তা। এ নিয়ে মোট গ্রেফতারির সংখ্যা দাঁড়াল ৮। ধৃতেরা সকলে ঠিকাদার সংস্থারই লোকজন।
তবে পুলিশের বক্তব্য, নির্মাতা সংস্থার তরফে যেমন, তেমন প্রকল্পের মূল হোতা তথা তত্ত্বাবধায়ক কেএমডিএ-র তরফেও গাফিলতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তাই সোমবার কেএমডিএ’র একাধিক ইঞ্জিনিয়ারকে ডেকে জেরা করেছে লালবাজার। প্রকল্পটির সঙ্গে কেএমডিএ-র কোন কোন অফিসার-ইঞ্জিনিয়ার জড়িত, সে তালিকাও পুলিশ বানিয়ে ফেলেছে। সেই সঙ্গে এ দিন দুপুরে লালবাজারে ডেকে পাঠানো হয়েছিল ঠিকাদার সংস্থা ‘আইভিআরসিএল’-এর সদর অফিসের তিন কর্তাকে। তাঁরা হলেন ডিরেক্টর (অপারেশন্স) এ গোপাল কৃষ্ণমূর্তি, ডিজিএম (প্রজেক্টস) এস কে রত্নম এবং এভিপি (প্রজেক্ট অ্যান্ড মনিটরিং) এ এন দিলীপ।
সন্ধ্যায় কৃষ্ণমূর্তি ও রত্নমকে গ্রেফতার করা হয়। শ্যামল মান্না ও বিদ্যুৎ মান্না নামে দুই সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারকেও লালবাজার হেফাজতে নিয়েছে। হায়দরাবাদের সদরে বসে পূর্ব ভারতে সংস্থার কাজকর্ম দেখভাল করতেন কৃষ্ণমূর্তি। পুলিশের বক্তব্য, সংস্থার কলকাতা অফিসের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক রঞ্জিত ভট্টাচার্যকেও জেরা করা জরুরি। কিন্তু তিনি বর্তমানে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। নির্মাণকাজে জড়িত বিতর্কিত সংস্থা ‘সন্ধ্যা কনস্ট্রাকশন’-এর কর্ণধার সেই রজত বক্সীরও হদিস মেলেনি। লালবাজারের অন্দরের ইঙ্গিত, সেতু-বিপর্যয়ের নেপথ্যে তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর ভাইপো রজতের ‘ভূমিকা’র কিছু প্রমাণ তাদের হাতে এসেছে।
নবান্ন-সূত্রের খবর, সেতু বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে এ জাতীয় নির্মাণকাজে সিদ্ধহস্ত তিনটি সরকারি সংস্থার সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে। এ বিষয়ে তাদের অনুরোধ পাঠানো হচ্ছে। যে সব কাঁচামাল দিয়ে সেতুটি বানানো হচ্ছিল, তার নমুনাও ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। ভেঙে পড়া উড়ালপুলের ভবিষ্যৎ কী?
প্রশ্নটি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। এ দিন নবান্নের এক কর্তা জানান, সরকারের গড়া বিশেষজ্ঞ কমিটি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবে। কাল, বুধবার কমিটির প্রথম বৈঠক হওয়ার কথা। এ দিন নবান্নে রাজ্য সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল রেলওয়ে বিকাশ নিগম লিমিটেড (আরভিএনএল)। রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে রেল বোর্ডের চেয়ারম্যানেরও কথা হয়। স্থির হয়েছে, আরভিএনএল সেতুর বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে থাকা অংশটি ভাঙতে শুরু করবে আজ, মঙ্গলবার। এ বিষয়ে কেএমডিএ-র সঙ্গে তাদের মউ সই হবে। ভাঙার কাজে লাগানো হবে ‘ডায়মন্ড কাটার’ নামে এক বিশেষ যন্ত্র। আরভিএনএল-ই আবর্জনা সরাবে। এ জন্য তাদের ২১ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। কেএমডিএ পুরো প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকবে না। আরভিএনএল’কে প্রয়োজনীয় জল ও বিদ্যুৎ জোগাবে কলকাতা পুরসভা। গত বৃহস্পতিবার দুপুর সওয়া বারোটা নাগাদ পোস্তায় গণেশ টকিজের কাছে নির্মীয়মাণ বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুলের একাংশ ভেঙে পড়ে। ২৬ জন মারা গিয়েছেন, আহত প্রায় ৯০। তদন্তে প্রকাশ, বুধবার রাত সওয়া বারোটা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ন’টা পর্যন্ত ওই অংশটিতে ঢালাই হয়েছিল। পুলিশের দাবি, ঢালাই তত্ত্বাবধান করতে কেএমডিএ-র দুই ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তাঁরা দায়িত্ব কতটা পালন করেছেন, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। পুলিশ বলছে, বৃহস্পতিবার সকালে ৪০ নম্বর স্তম্ভের কিছুটা বসে যায়। পিলারের বিমের উপরে কংক্রিটের স্ল্যাব বসাতে গিয়ে নাট-বল্টু ভেঙে বেরিয়ে আসে। শ্রমিকেরা সে দিকে ওঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তবু কাজ বন্ধ হয়নি। এমনকী, সে দিন সকাল থেকে কাঠামোটি বার বার কেঁপে উঠলেও গা করা হয়নি বলে অভিযোগ। কেন হয়নি, তা জানতেই এ দিন কেএমডিএ’র ইঞ্জিনিয়ারদের জিজ্ঞাসাবাদ। এ দিকে রজত বক্সীর ‘সন্ধ্যা কনস্ট্রাকশনের’ মতো আরও কয়েকটি সংস্থা সেতু নির্মাণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত ছিল। তেমনই একটি হল রনি কনস্ট্রাকশন, যার মালিককে ঘটনার দিন আনন্দপুরে আইভিআরসিএলের রে়ডিমিক্স প্লান্টে ও লালবাজারে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যদিও রনি’র মালিক প্রবীর ভট্টাচার্য দাবি করেছেন, ঢালাইয়ের সময়ে রাস্তায় পড়া মাল-মশলা সাফ করার কাজই শুধু করতেন তাঁরা, মূল নির্মাণের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ নেই। এ নিয়ে রাজনীতির চাপান-উতোরও অব্যাহত। ঘটনায় ‘তৃণমূল-যোগের’ অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিদায়ী পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি চেয়ে এ দিন বিজেপি শহরে মিছিল বার করেছিল। সমাবেশে দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ ও রাজ্যের সহ পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ ফের সিবিআই-তদন্তের দাবি তুলেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy