Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মূক-বধির-মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়েকে জমা দিয়ে এলেন দশ দিনের মা

কখনও আবার হাত ছাড়িয়ে এ দিক–ও দিক দৌড়োদৌড়ি। পিছনে পিছনে দৌড়চ্ছেন সেই মহিলাও।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

দীক্ষা ভুঁইয়া
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ২২:২৪
Share: Save:

মহিলার হাত কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না ছোট্ট হাত দুটো। কখনও জড়িয়ে ধরছে, কখনও বুকে মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে থাকছে। কখনও আবার হাত ছাড়িয়ে এ দিক–ও দিক দৌড়োদৌড়ি। পিছনে পিছনে দৌড়চ্ছেন সেই মহিলাও।

পাঁচ-ছ’বছরের মূক-বধির ও মানসিক প্রতিবন্ধী এক শিশুকে দশ দিন ধরে এ ভাবেই নিজের সন্তানের মতো যত্ন করেছেন দমদমের বাসিন্দা স্বাতী রায়। কিন্তু ফেলে যাওয়া ওই শিশুটিকে তো আর নিজের করে নেওয়া যায় না। অগত্যা মনের কষ্ট চেপে রেখেই ছলছল চোখে দমদম থানায় এসে তিনি ওই শিশুকন্যাকে তুলে দিয়ে গেলেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলার চাইল্ড লাইনের হাতে।

কী করে খুঁজে পেলেন মেয়েটিকে? সোমবার দমদম থানা চত্বরে বসে স্বাতীদেবী জানালেন, দমদমের কদমতলায় খুচরো মাছ কিনে বিক্রি করেন তাঁর স্বামী রবিন রায়।

আর তিনি পরিচারিকার কাজ করেন। তাতেই নিঃসন্তান দম্পতির সংসার কোনও রকমে চলে যায়। গত ২৬ এপ্রিল সকালে মেয়েটির হাত ধরে রবিনবাবুর দোকানের সামনে আসেন এক ব্যক্তি। শিশুটিকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রবিনবাবুকে বলেন, তাকে একটু দেখতে। তার পরেই বেপাত্তা হয়ে যান তিনি। রবিনবাবু ভেবেছিলেন, ওই ব্যক্তি বাজার করবেন বলে মেয়েকে রেখে গিয়েছেন। একটু পরে এসে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সময় গড়াতে থাকে। সেই ব্যক্তি আর ফেরেননি। পরে বেলা দুটো নাগাদ মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে এনে তোলেন রবিনবাবু।

বাজারের আশপাশের দোকানদারদের বলে আসেন, মেয়ের খোঁজ করতে কেউ এলে যেন তাঁর মোবাইল নম্বরটা দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কেউ আসেননি। তাই ফোনও আসেনি। কিন্তু ওইটুকু মেয়েকে নিয়ে কী করবেন, ভেবে পাননি ওই দম্পতি। মেয়েটি কথা বলতে পারে না। ভাল করে শুনতে পায় না। চোখেও কম দেখে। কয়েক দিন নিজেদের কাছে রাখার পরে দমদম থানায় শিশুটিকে দিয়ে আসতে যান তাঁরা। কিন্তু অভিযোগ, থানা বলে, এটি কোনও হোম নয়। তাঁরা যেন কোনও হোমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

এর পরেই ওই দম্পতি ফোন করেন কলকাতার চাইল্ড লাইনে। তাঁরা বলেন, আরও এক-দু’দিন বাচ্চাটিকে রাখতে। তাঁরা গিয়ে নিয়ে আসবেন। কিন্তু দিন দশেকের মধ্যেই শিশুটির মায়ায় জড়িয়ে পড়েন স্বাতীদেবী। মন চায়নি তাকে ফেরত দিতে। অথচ এ রকম একটি শিশুকে সুস্থ ভাবে বাঁচিয়ে রাখার মতো আর্থিক অবস্থাও তাঁদের নেই। তাই বুকে পাথর চাপা দিয়েই সোমবার বিকেলে চোখের জলে ওই শিশুকন্যাকে তুলে দিলেন চাইল্ড লাইনের হাতে।

দেওয়ার সময়ে স্বাতীদেবী বলেন, ‘‘যেখানেই থাক, যেন ভাল থাকে। সুস্থ থাকে। জানি না, পরে গেলে আমাকে দেখতে দেবে কি না। আমার মনটা কিন্তু ওর জন্য কাঁদবে।’’ এই দশ দিনে ওই শিশুকন্যাকে কখনও মৌসুমী, কখনও মামন বলে ডেকেছেন তিনি। জানালেন, এই ক’দিনে ওই মেয়েও ভাল ভাবে চিনে গিয়েছে তাঁকে। রাতে মশারির ভিতরে স্বাতীদেবী না ঢোকা পর্যন্ত মুখ বাড়িয়ে বসে থাকত শিশুটি। দশ দিনের এমনই নানা স্মৃতি বুকে নিয়ে খালি হাতে সোমবার বাড়ি ফিরলেন স্বাতীদেবী।

আর চাইল্ড লাইনের লোকজন? তাঁরা স্বাতীদেবী ও রবিনবাবুর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, ‘‘আজকের দিনে এ ভাবে বাচ্চাকে কেউ রাখতে চায় না। ওঁরা এত যত্নে রেখেছিলেন, যা দেখে মনে হচ্ছে, এখনও মানবিকতা বেঁচে রয়েছে। ’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Woman Mother Kolkata কলকাতা
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE